শ্রীমঙ্গল উপজেলা ডাকঘর আজো সাব-ডাকঘর! আয় প্রথম শ্রেণীর
বিকুল চক্রবর্তী॥ শ্রীমঙ্গলের প্রধান ডাকঘরটি আজও সাব-ডাকঘর হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে তার কর্মকান্ড। অথচ টার্গেট পুরণ করছে প্রথম শ্রেণীর।
প্রথম শ্রেণীর ডাক ঘরে উন্নিত না করায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অতচ প্রথম শ্রেণী হওয়ার অনুকুলে সকল সক্ষমতা রয়েছে এ পোষ্ট অফিসটির।
আর বর্তমানে এটি তৃতীয় শ্রেণীর ডাকঘর হলেও এর আয় ও গ্রাহক সংখ্যা প্রথম শ্রেণীর সমান। এটিকে প্রথম শ্রেণীর ডাকঘরে রূপান্তরিত না করায় গ্রহকদের ভূগান্তির শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত। বর্তমানে এর মাসিক লেনদেন ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। আর এটি প্রথম শ্রেণীতে উন্নিত হলে তা শত কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে কয়েকগুন।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলাটি সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই একটি উন্নত ব্যবসায়ীক অঞ্চল। যেখানে একসময় মারোয়ারীরা ব্যবসা করতেন এবং পরবর্তিতে বিট্রিশরা চা বাগান করার পর তা আরো সমৃদ্ধ হয়। যেখানে চালু হয় সিলেট বিভাগের অন্যতম আরদদারী বা পাইকারী ব্যবসা কেন্দ্র।
সেই বিট্রিশ আমল থেকেই এখানে সিলেট বিভাগ তথা চট্টগ্রাম বিভাগের বেশ কিছু অঞ্চলের পাইকার রা শ্রীমঙ্গলের বাজার থেকে মালামাল সংগ্রহ করতেন। এখনও শ্রীমঙ্গলের আরদদার/পাইকারী ব্যবসা অভ্যাহত রয়েছে।
এর আগে ত্রিপুরা রাজা এখানে নিয়মিত আসতেন। শ্রীমঙ্গল হবিগঞ্জ সড়কে রাজ কাছারীতে বসতেন। যে কারনেও এখানে গড়ে উঠে নগরায়ন।
আর চা বাগান হওয়ার পর এর গুরুত্ব বেড়ে যায় আনেকগুন। আর শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অর্ধশতাধিক পর্যটন স্পর্ট থাকায় এর ব্যবসায়ীক পরিধিও বেড়েছে আশাব্যঞ্জক।
কয়েক বছর আগে শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপন হওয়ায় গুরুত্ব বাড়ে আরো কয়েক গুন। এই সকল ব্যবসায়ীদের কথা এবং এ উপজেলার নাগরিকদের সুবিধাদি বিবেচনা করে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ডাকঘরটি অনেক আগেই প্রথম শ্রেণী বা ২য় শ্রেণীর প্রধান ডাকঘর হওয়ার কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টির এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ার কারনে তা আজো আলোর মূখ দেখেনি। এতে দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী শ্রীমঙ্গলের ডাকঘর থেকে প্রথম শ্রেণীর সুবিধা সম্বলিত সেবা বঞ্চিত গ্রাহকরা। এ অবস্থায় বর্তমানে অনেক ব্যবসায়ীরা এই ডাকঘর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছেন।
এদিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর হলেও এখানে রয়েছে প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা, রয়েছে বিজিবির সেক্টর, ব্যাটালিয়ন, রয়েছে চা গবেষনা কেন্দ্র, চা বোর্ডেও প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট, পল্লিবিদ্যুৎ সমিতির মৌলভীবাজার জেলা অফিস, পাওয়ার গ্রিড এর মৌলভীবাজার জেলা অফিস, প্রথম শ্রেণীর রেলওয়ে স্টেশন, রয়েছে র্যাব-৯ এর হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার জেলার প্রধান অফিস, রয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ান, বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষন বিভাগ, জেলা বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ও রেঞ্জ কর্মকর্তার পৃথক পৃথক কার্যালয়, বিভাগীয় শ্রম কল্যাণ অফিস, জেলা কলকারাখানা অফিস, পদ্মা মেঘনা যমুনার বিভাগীয় ডিপু, রয়েছে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের কার্যালয়। এছাড়াও রয়েছে অর্ধশতাধিক এনজিও, ৪৬টি চা বাগান, বেশ কয়েকটি সরকারী বে-সরকারী রাবার বাগান, রয়েছে পাঁচ তারকা মানের হোটেলসহ অর্ধশতাধিক হোটেল রিসোর্ট। আছে অর্ধশতাধিক ব্যাংক বীমা অফিস। আর হাজার হাজার প্রবাসীতো আছেনই।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ডাকঘরের ভারপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার আব্দুল মতিন জানান, চলমান আধুনিক যুগে এ ডাকঘরটি এখনও তৃতীয় শ্রেণীর অফিস হিসেবে আছে। অতচ বহুবছর আগে থেকেই এটি ২য় শ্রেণীর প্রধান ডাকঘরে উন্নিত হতে মাসিক ২০ কোটি টাকার উপরে লেন দেন অতিক্রম করে। বর্তমানে এর লেনদেন প্রায় ৩০ কোটি টাকা, যা প্রথম শ্রেণীর ডাকঘরে উন্নিত হওয়ার টার্গেট। তিনি জানান, বর্তমানে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতি বিমূখ। একজন গ্রাহক বই জমা দিলে তা মৌলভীবাজার ঘুরে এসে টাকা পেতে সময় লাগে প্রায় ১৫দিন থেকে এক মাস। এখন যে ২৫ কোটি টাকার উপরে আয় হয় তা সঞ্চয় ব্যাংক, সঞ্চয় পত্র, রেজিষ্টার ইস্যু, দৈনিক পার্সেলসহ অনান্য খ্যাত থেকে। তিনি জানান একসময় লেনদেন ছিল প্রায় ৫০ কোটি। সুবিধা না পাওয়ায় এখন কমেছে।
শ্রীমঙ্গল ডাকঘরের অপারেটর সবিতা রানী রায় জানান, শ্রীমঙ্গলে অনেক প্রবাসী রয়েছেন। ২য় ও প্রথম শ্রেণী না হওয়ায় এখানে লোকবল ও অবকাঠামো কম। গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে হলে আগে মৌলভীবাজারে চাহিদা দিতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী টাকা আসলে পরে তা দিতে হয়। এতে গ্রাহক তার প্রয়োজনীয় সময়ে টাকা পান না। বার বার গিয়ে খোজ নিতে হয় ডাকঘরে।
শ্রীমঙ্গল ডাকঘরের প্রবীণ গ্রাহক অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক বিরেন্দ্র দেবনাথ বলেন, বিগত ৫৩ বছর ধরে তিনি এই ডাকঘরে লেনদেন করে আসছেন। তার আয়ের অংশ তিনি এখানেই সঞ্চয় করেন। কিন্তু যুগ পাল্টেছে। সব কিছু আধুনিক হয়েছে আধুনিক হয়নি এই ডাকঘরটি। তিনি বলেন, এখান থেকে টাকা উঠাতে হলে কয়েকবার আসতে হয়। আধুনিক বিশে^ কোথাও এমটা করতে হয়না। তিনি বলেন, ২য় শ্রেণী নয় এটি প্রথম শ্রেণীতে উন্নিত হওয়া এখন সময়ে দাবী। এ সময় তিনি আরো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের প্রখর দৃষ্টি জন্য আমাদের দেশের সরকার গরিব, আর জনগনের একটা অংশ ধনি। অতচ উন্নত রাষ্ট্রে সরকার ধনি।
অপর গ্রাহক ডা: নজিবুস শহীদ বলেন, এটি প্রথম শ্রেণীতে উন্নিত হলে এর নিয়ন্ত্রিত অনান্য শাখা অফিস গুলোতেও লেনদেন বাড়বে। তখন কালিঘাট, সাতগাওসহ অনান্য শাখা ডাকঘর গুলোও শ্রীমঙ্গল প্রধান ডাকঘর থেকে দিনে দিনে টাকা নিয়ে তা গ্রাহকদের দিতে পারবেন। এতে গ্রামীণ সেবা আরো উন্নত হবে। তা ছাড়াও প্রথম শ্রেণীর অবকাঠামো নির্মানের জন্য যে জমির প্রয়োজন তাও আছ।
উপজেলা ভারপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার আব্দুল মতিন আরো জানান, শ্রীমঙ্গল পোস্ট অফিসের ৪৫ শতাংশ জায়গা রয়েছে এর মধ্যে বর্তমান ছোট এই ভবন ছাড়া বাকী জায়গা পতিত। লোকবল বৃদ্ধির পাশাপাশি অচিরেরই প্রয়োজন সম্প্রসারিত ভবন।
শ্রীমঙ্গলের এই ডাকঘরটি বিট্রিশ আমলের। এখন বিট্রিশ আমলের ও পাকিস্তান আমলের সিল রয়েছে এখানে। এটি ২য় শ্রেণীর প্রধান ডাকঘরে উন্নিত না হওয়ায় এখানে লোকবলের চরম সংকট। এদিকে তৃতীয় শ্রেণীর ডাকঘরের জন্যও যেখানে লোকবল দরকার ১৮ জন সেখানে আছে ৯জন।
কাতার প্রবাসী সুব্রত চক্রবর্তী জানান, শ্রীমঙ্গল পোস্ট অফিসটি ৩য় শ্রেণীর হওয়ায় বর্তমানে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইর্মাজেন্সি মেইল সার্ভিস (ইএমএস) সার্ভিস পাচ্ছিনা। এটি প্রথম শ্রেণী বা ২য় শ্রেণীতে উত্তির্ণ হলে আমরা এ সার্ভিস পাবো।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল পোস্টঅফিস পরিদর্শক আবু সালে মোহাম্মদ আল রাজীব বলেন, শ্রীমঙ্গল শাখা ২য় শ্রেণীর প্রধান ডাকঘরে উন্নিত হলে এই ব্রান্সের নিজস্ব একটি একাউন্ট থাকবে। একাউন্টে সবসময় স্থিতি থাকবে যার মাধ্যমে গ্রাহকদের দ্রুত সেবা দেয়া যাবে।
এ ব্যাপাওে মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এমপি বলেন, শ্রীমঙ্গল পোস্ট অফিসটি প্রাচীণ একটি পোস্ট অফিস। এর নাগরিক সেবা বৃদ্ধিতে ২য় শ্রেণীর প্রধান ডাকঘরে উন্নিত হওয়ার প্রস্তাব আসলে “আমি বিগত বছরের ডিসেম্বরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বরাবরে ডিও দেই এবং ব্যক্তিগতভাবে সুপারিশও করি। জনগনের স্বার্থে ও বাস্তবতা নিরিখে মন্ত্রনালয়কে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করছি।”
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ ডিভিশনের সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল সুজিত চক্রবর্তী জানান, শ্রীমঙ্গল পোস্ট অফিসটি সি গ্রেড থেকে বি গ্রেডে উন্নিত হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম সার্কেল অফিসে আবেদন প্রেরণ করা হয়েছে। সার্কেল অফিস থেকে ২য় শ্রেণীতে রুপান্তরের জন্য ঢাকা ডিজি অফিসে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে এর গুরুত্ব উল্লেখ করে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও দিয়েছেন। পাশাপাশি সত্যতা নিরেখে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীও এর জন্য সুপারিশও করেছেন। এটি ২য় শ্রেণীতে উন্নিত হওয়ার সকল শর্তই বিদ্যমান আছে। তিনি জানান, এটি ২য় শ্রেণীতে উন্নিত হলে সরকারের রাজস্ব অনেকগুন বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি এর লোকবলও বাড়বে ।
শ্রীমঙ্গলবাসীর দাবী অচিরেই এই ডাকঘরটিকে সরকার প্রথম শ্রেণী বা ২য় শ্রেণীর প্রধান ডাকঘরে রুপান্তরিত করবেন। এতে এলাকাবাসীর যেমন উপকার হবে তেমনি প্রচুর রাজস্ব পাবে সরকার।
মন্তব্য করুন