সন্ত্রাস,আজকের সমাজ ব্যবস্থা ও আমাদের করণীয়

সৈয়দ মহসীন পারভেজ॥ বায়ান্নের রক্তধারা। একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহীদ। অগণিত মায়ের অশ্রু। কোটি মানুষের অত্মত্যাগ। আর সংগ্রামের অগ্নিগর্ভ দ্যোতনায় গৌরবোজ্জল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাণণপ্রিয় স্বাধীনতা। এই স্বাধীন সার্বভৌম রক্তক্ষয়ী ত্যাগে অর্জিত বিজয়ের যে দেশ, সে দেশের প্রধান সমস্যা সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা। এতে বোধ হয় কারো দ্বিমত নেই। পাশাপাশি বাস্তব সত্য হচ্ছে সকলের সমবেত স্বীকৃতি ও স্বীকারোক্তি সত্বেও সন্ত্রাস তো বন্ধই হচ্ছেই না। সন্ত্রাসীদের দাপটও কমেছে না। এই অবস্থায় স্বীকার করতেই হবে স্বাভাবিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পুলিশসহ প্রশাসন যন্ত্র কোনটারই যথাযথভাবে কার্যক্রম নেই। সনাতন অপরাধ যেমন চুরি ডাকাতি সম্পত্তি বা অন্য দ্বন্ধ-দ্বেষ থেকে উদ্ভুত বিভিন্ন ফৌজদারী অপরাধ থেকে আলাদাভাবে দেখছি। এ সন্ত্রাস অভাবজনিত চুরি ডাকাতি নয়। ব্যক্তিগত আবেগজনিত দ্বন্ধ-দ্বষ থেকে সৃষ্টি নয় বরং কিছু মানুষের দলবদ্ধভাবে সমাজে তাদের জবরদস্তি চালিয়ে একাধিপত্য কায়েমের হীন চেষ্টা থেকেই এ সন্ত্রাসের জন্ম। তারা এ জন্য তারুন্য,ছাত্রত্ব রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতাবোধের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদিকে পুঁজি হিসাবে খাটায়। এসব কারণ যে কোনো মূল্যে নিজেদের আধিপত্য সহজ হয়। কোনো সমাজে এক বা একাদিক দল নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এবং তার চায় যে কোনো মূল্যেই। তখন তা সভ্য সমাজে রাজনীতি ও আইন-কানুননের প্রতি হুমকীস্বরুপ হয়ে উঠে। তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠা ও দীর্ঘ দিন ক্রমবর্ধমানহারে তা চলতে থাকার অর্থ হলো সমাজে প্রচলিত আইন কানুনের বাস্তবায়ন অচল হয়ে পড়া। এর কারণ হিসেবে বলা যায় সম্পর্ক অকার্যকর হওয়ার মাধ্যমে যেমন তা ঘটতে পারে। আবার নীরবে সন্ত্রাসের সাথে আপোসের কারণেও অচল হতে পারে। সমাজে দু’ ধরণের অভিভাবকত্ব আছে। স্বাভাবিক অভিভাবকত্ব যা পরিবার পাড়া ও সমাজের মুরব্বীদের মাধ্যমে সৃষ্টি। অপরটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অভিভাকত্ব যার প্রকাশ ও বাস্তবায়ন ঘটে পুলিশ প্রশাসনেসহ অন্যান্য প্রশাসনের মাধ্যমে। এ দুয়ের মধ্যে অর্থাৎ সমাজ ও প্রশাসনের মধ্যে সরাসরি সক্রিয় যোগাযোগ ও ভূমিকা আছে রাজনীতির তথা রাজনৈতিক নেতা ও দলের। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নানা কারণে সমাজে সবকালেই রাজনীতিই মূখ্য বিষয় হয়ে উঠে। এবং সেই রাজনীতি যদি হয় মূলত ক্ষমতামূখী তবে তাতেই সৃষ্টি হতে থাকে নানা সমস্যা। বলতে গেলে আমাদের সমাজে রাজনীতির ক্ষমতার অপ-ব্যবহারের এক মহোৎসব পর্ব চলছে। সুস্থ রাজনীতির শূণ্যতা থেকেই কল্যাণকামী মানবমূখী রাজনীতির পরিবর্তে ক্ষমতা ও স্বার্থসিদ্ধ রাজনীতির জন্ম হয়েছে। বলা চলে রাজনীতি আজ প্রকৃত রাজনীতিবীদের হাতে নেই। চলে গেছে ব্যবসায়ী ও রাগবোয়ালদের হাতে। চক্ষুস্মান বিবেকবান রাজনীতির স্থান দখল করেছে অন্ধ পাষন্ড দানবীয় রাজনীতি। স্বাধীনতার পর ও নেতৃত্ব সৎ চক্ষুমান রাজনীতি স্বজনের লক্ষ্যে উদগ্রীব ও আকুল। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বস্তুত রাষ্ট্র ক্ষমতা জবর দখল করা হয়। আর জবর দখলকে কাযেম রাখতে ও বৈধতা দিতে গিয়ে গলা টিপে হত্যা করতে হয়েছে যোগ্য চক্ষুমান বিবেকবান রাজনীতির ধারাটিকে। রাষ্ট্র ক্ষমতা হত্যাকারীদের সাথে আপোস করেছে। জবর দখলকে মেনে নিয়েছে। স্বীকৃতি দিয়েছে জবরদস্তির রাজনীতিকে। একটি অন্যায়ের সাথে আপোস আরো অন্যায় অবশ্যম্ভাবী করেছে। এবং এভাবে অন্যায়ের স্তুপ থেকে অন্ধ পাষন্ড দানব রাজনীতির জন্ম হয়েছে। যা বিকাশিত হয় সন্ত্রাসের মদদে। অন্যদিকে বিশ^ যখন উন্নয়নের লাগামহীন ঘোড়া দৌঁড়াচ্ছে আমরা তখন ধর্মের জিগির তুলে হাদিস-কুরআন বর্জিত ফতোয়াবাজি করে মধ্যযুগীয় নির্যাতনের স্বীকার আকলিমা,তানিয়া, নূরজাহান। মসজিদ মন্দির ভেঙ্গে তপোবনে বসে রাম রাম নাম জপছি,তপসি টিপছি। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে মৌলবাদী অপশক্তি বিভক্ত করতে চাইছে বাঙ্গলি জাতির অবহমান কালেন লালিত ঐতিহ্যকে। প্রতিযোগিতা চলছে মসজিদ মন্দির ভাঙ্গার পাশবিক বাস্তবতায়। বাংলার মাটি দূর্জয় ঘাঁটি দেখে নিক দুর্বৃত্তরা। কবির এই দৃঢ় উচ্চারণ আজ সন্ত্রাসীদের দানবীয় শব্দে কাছে মৃত। এর কাছে কি সপে দেব নিজেদের বিবেক বুদ্ধিকে? নিজের সৃজনশীলতা মনুষ্যত্ব? আমরা কি সমাজ দানবের অন্ধ বিকারে সংক্রমিত হলেও দানবের বিরুদ্ধে মানুষ লড়েছে। ৯০ এর গণআন্দোলন দানবের বিরুদ্ধে সামাজিক মানবিক আন্দোলন ধিক্কারই এর জলন্ত প্রমাণ। অন্ধ দানবীয় রাজনীতিকে ধিক্কার দিয়ে ৯০ এর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বার্তাবরণ উন্মুক্ত করেছিল। তরুণরা কেন এই চোরাবালিতে পা দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। বেকারত্ত্ব যার সাথে যুক্ত দরিদ্র। শিক্ষা ব্যবস্থার কারণও রয়েছে। বাস্তমূখী বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব। অন্ধ রাজনীতির নির্লজ্জ দাপটের ফলে হতাশ ও দিশাহীন তরুণ ও সার্বিক দেউলিয়াত্বসহ এভাবে আরও অনেক কারণ খোঁজে পাওয়া যাবে। শোষান্তে বলেতে চাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করা যাবেনা। এককভাবে সফল হবে না যদি পাশাপাশি অপরাধের যে চোরাবালি তৈরি হয়েছে তা শুদ্ধ করার কাজ না হয়। বলা উচিত সেটাই এখন অধিকতর জরুরি । কারণ তাতেই অপরাধের জন্ম লালন বিকাশের প্রক্রিয়া রোধ হবে। সমাজে তা লালন না করলে অপরাধীরা বিচ্ছিন্ন ও চিহ্নত হয়ে যাবে। এই জন্য দরকার উদ্যোগী তরুণ তরুণীদের জন্য কর্মসংস্থান। চাই জড়তা অন্ধতাহীন শিক্ষা ও সংস্কৃতি যা প্রজ্জ্বলিত করবে মনুষ্যত্বের শিখা। ছাত্র ছাত্রীদের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি চাই ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ব্যাপক আয়োজন। তারুণ্যকে বিকাশমান ধারায় অবক্ষয়ের হাত থেকে বাচাঁতে হবে। তাই আসুন সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গড়ে তুলি গণজাগরণ।
লেখক- সৈয়দ মহসীন পারভেজ, সিনিয়র সাংবাদিক, পরিবেশ আন্দোলন নেতা, এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ এর স্টাফ রিপোর্টার।
মন্তব্য করুন