সিলেট-আখাউড়া রেলপথ : মনু ও পলকী নদী রেলসেতু ও রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ

January 8, 2017,

ইমাদ উদ দীন॥ রেল বিভাগের দাবী ঝুঁকিহীন তারপরও উদ্বিগ্ন যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্ধারা। কারণ সেতু দু’টির উপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের পর বেঁকে যাচ্ছে রেল লাইনের সবকটি স্লিপার। আর পুরনো ক্লিপ-হুক,নাট-বল্টু,ফিশপ্লেট যে কয়টি আছে সে গুলো ট্রেনের ঝাঁকুনিতে নড়াচড়া করে স্থানচ্যুত হচ্ছে।
সেতু দু’টির মধ্যখানে ও তীরবর্তী দু’পাশের রেল লাইনের বেশ কয়েকটি স্থানে নেই ক্লিপ-হুক,নাট-বল্টু আর ফিশপ্লেট। লাইনের জোড়া লাগানো অংশের নাট গুলোও অকেজ। ৪-৬টি নাটের মধ্যে ১-২টি নাট কাজ করলেও অন্য গুলো আছে নাম মাত্র। আর সেতু দু’টির উপরে কাঠের জরার্জীন স্লিপারের অধিকাংশই নষ্ট। এমনকি সেতুর মধ্য খানে ও উত্তর পাশের সীমানা অংশে নেই ৫-৬টি স্লিপার। আবার অনেক স্থানে স্লিপার সরে ফাঁকা হয়ে গেছে। ট্রেন চলাচলে যাতে স্লিপারগুলো বাঁকা না হয় সে জন্য পুরো সেতুর রেল লাইনে সম্প্রতি লম্বা করে ফালি করা বাঁশে পেরেক দিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে স্লিপার আটকানোর চেষ্টা চালিয়েছে রেল বিভাগের কর্মীরা।


তারপরও বেঁকে যাচ্ছে স্লিপার। তাই ট্রেইন যাওয়া আসার পর কিম্যানের দ্বায়িত্বে থাকা কর্মীরা হাতুড়ি পিটিয়ে বেঁকে যাওয়া স্লিপার পুনরায় সোজা করছেন।
সরজমিনে সিলেট-আখাউড়া রেলপথের কুলাউড়ার ২০৫ নং পলকী নদী ও ২০৬ নং মনু নদী রেলসেতুতে গেলে এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে। সেতু দু’টিতে দীর্ঘদিন থেকে কোন মেরামত না করায় এখন দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এমনটিই জানালেন স্থানীয় বাসিন্ধারা। তবে ব্রীজ দু’টির উপরের রেল লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচলে কোন ধরনের ঝুঁকি নেই বলে অভিমত রেল বিভাগের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের। তবে রেল বিভাগের এমন অভিমত মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্ধা ও সচেতন মহল। তারা জানালেন বৃটিশ আমলের নির্মিত ব্রীজ দু’টির উপরের রেল লাইনের এমন বেহাল দশা এর আগে কখনো দেখননি তারা। ট্রেন যাওয়া আসার সময় বিকট শব্দে সেতুর উপরের রেল লাইন কেঁপে স্লিপার বেঁকে যাচ্ছে। আর ক্লিপ-হুক,নাট-বল্টু,ফিশপ্লেট গুলো ট্রেনের ঝাঁকুনিতে নড়াচড়া করে স্থানচ্যুত হচ্ছে। তারা ক্ষোভের সাথে জানালেন প্রতিবছরই মেরামতের জন্য বরাদ্ধ আসলেও কোন ধরণের মেরামত কাজ হয়নি এই দুটি সেতুর রেল লাইন ও আশপাশের রেল লাইনে। তারা অভিযোগ করে বলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও পকেট ভারীর চিন্তায় দিন দিন ঝুঁকিতে পড়ছে এই সেতু দু’টির রেল লাইন ও সিলেট আখাউড়া রেল লাইন। স্থানীয় বাসিন্ধারা জানালেন এই রেল সেতু দু’টির উপরের রেল লাইনের বেহাল দশায় আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ এই স্থানে কোন ধরনের ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটলে নাশকতা বলে রেল বিভাগের দ্বায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়সারা বক্তব্য দিয়ে কিংবা তদন্ত করে আমাদের নাশকতাকারী বানিয়ে মামলার আসামী করবেন। তারা অভিযোগ করে বলেন টিলাগাঁও এলাকায় এরকম একটি ট্রেন দূর্ঘটনায় তাদের এলাকার অনেকেই নাশকতার মামলার আসামী হয়ে এখন মামলার ঘানি টানছেন। তাই মেরামতের আগ পর্যন্ত এই ঝুঁকিপূর্ণ দুটি স্থান নিয়ে তারা রয়েছেন শঙ্কায়।


সরজমিনে ব্রীজ দু’টির উপরের রেল লাইনের এমন বেহাল দশার দৃশ্য চোখে পড়ে। ম্যাইট ম্যান দিল মোহাম্মদের তদারকিতে ট্রেন যাওয়ার পর কিম্যান কামাল হোসেন (৪০) ও রহমান আলী (৫৩) হাতুড়ি পিটিয়ে সেতুর উপরের রেল লাইনের বেঁকে যাওয়া স্লিপার মেরামত করছেন। তাদের এমন হাতুড়ি পেটায় পুরানো রেলের কাঠের স্লিপারগুলো ভেঙে পড়ছে। রেলওয়ের এই কিম্যান (রক্ষণাবেক্ষণকর্মী) রা সেতুর ওপরে নাট-বল্টু লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্লিপারের সঙ্গে নিচের গার্ডারের সংযোগ দেওয়ার চেষ্ঠা করছেন। এখন দিনে দুই-তিনবার ওখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তারা। কোথাও ত্রুটি থাকলে সারেন। আগে এমন মেরামতের কাজ না করলেও এখন ঝুঁিক এড়াতে প্রতিনিয়তই তারা এমন কাজ করছেন বলে আলাপে জানাগেল। বাঁশের ফালি লোহার পেরেগ দিয়ে স্লিপারের সাথে আটকানো কেন।
এমনটি জানতে চাইলে ম্যাইট ম্যান দিল মোহাম্মদ জানান কাটের স্লিপার যাতে স্থানচ্যুত না হয় সে জন্য এব্যবস্থা। নাট বল্টু নড়ছে স্লিপার স্থানচ্যুত হচ্ছে এ অবস্থায় ট্রেন চলাচলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি দৃঢ় ভাবে জানালেন না। তবে সেতু দুটির উপরের রেল লাইনের অবস্থা যে নাজুক প্রথমে তিনি তা অস্বীকার করলেও নানা ত্রুটি বাস্তবে দেখিয়ে দিলে পরে তিনি তা স্বীকার করেন।


তিনি জানান ৩১৫/৫ থেকে ৩০২/৮ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তা ২জন কি ম্যান ৪জন ওয়াইম্যান ও ১জন ম্যাট ম্যান দেখভাল করছেন। তবে ওই দু’টি সেতু এলাকা ছাড়াও সরেজমিন আশপাশের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে রেল লাইনের ভেতরে নেই পর্যাপ্ত পাথর। রেলপথে স্লিপারে নাট-বল্টু দিয়ে রেল লাইন আটকানোর কথা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে নেই ক্লিপ,নাট ও বল্টু। দু’লাইনের জোড়া দেয়া স্থানেও নেই ক্লিপ ও ফ্লিশপ্লেট। তবে রেল বিভাগের অভিযোগ প্রতিনিয়ত রেলপথ থেকে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় এসব যন্ত্রাংশ না থাকায় সেকশনটি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। চুরি হয়ে যাওয়া কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া এসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না। ফলে এই সেকশন দিয়ে ঘণ্টায় ৬০ কি.মি. বেগে প্রতিদিনই যাত্রীবাহী আন্ত:নগর,লোকাল ও মালবাহী ট্রেন মিলে প্রায় ২৫ টি ট্রেন ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে।


রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, মনু নদীর ওপর প্রায় ৩শ মিটার দৈঘ্যের এ সেতুতে ২০৮টি স্লিপার রয়েছে। সেতুটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন বা কেপিআই) মধ্যে পড়েছে। মনু রেলস্টেশনের পাশ ঘেঁষেই সেতু দু’টির অবস্থান। মনু ব্রীজের পরেই অবস্থান পলকী নদী ব্রীজের ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটিতে ১৬৯টি স্লিপার রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন থেকে মনু স্টেশনে মাস্টারসহ লোকবল না থাকায় ঝুঁকির মুখে থাকা সেতু দু’টিতে যেকোনো সময়ে দুর্ঘটনা আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্রেনচালক জানালে,ট্রেন চালানোর সময় রেললাইনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কোনো কারণে স্লিপার স্থানচ্যুত হয়ে রেললাইন সরে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হবিগঞ্জের লস্করপুর থেকে কুলাউড়ার টিলাগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত এলাকার দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী আলী আজম বলেন,কাঠের সংকটের কারণে নতুন স্লিাপার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।
তাই পুরানো কাঠের স্লিপার জায়গা মতো না থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থেই পেরেক দিয়ে বাঁশের টানা দেয়া হয়েছে। তবে পুরো রেলপথে ১৫ থেকে ৩০ দিন অন্তর প্রকৌশলীরা পর্যবেক্ষণ করছেন। আমাদের তরফে রেলপথ ঠিক রাখতে যথাসম্ভব চেষ্টার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না এবং ট্রেন চলাচলে কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নেই বলে তিনি দাবি করেন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com