মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : বিশ্ব শান্তির জন্য প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী বিশ্ব নেতা

October 24, 2016,

মোহাম্মদ আবু তাহের॥ প্রয়াত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডী ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিষেক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বলেছিলেন Òdon’t ask what your country can do for you, but what you can do for your country.Ó কেনেডীর এই বক্তব্যে সত্যিকারের দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। আগামী ৮ নভেম্বর ২০১৬ বিশ্বের প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিদিনই গণমাধ্যমে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষের নজর এখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর সকল বিবেকী মানুষ প্রত্যাশা করবে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এমন একজন নেতাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন যিনি পৃথিবীর সকল মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন “গণতন্ত্র নিখুঁত ব্যবস্থা নয়, কিন্তু এর চেয়ে কোনো ভালো ব্যবস্থাও আমাদের নাগালের মধ্যে নেই।” হিংসা বিদ্বেষের পথ পরিহার করার জন্যই গণতন্ত্রের উদ্ভাবন। প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে প্রায় দশ কোটি দর্শকদের ৬২ শতাংশই হিলারীকে এবং ২৭ শতাংশ ট্রাম্পকে জয়ী বলে রায় দিয়েছেন। হিলারী বনাম ট্রাম্পের নির্বাচনী দ্বিতীয় বিতর্কের পর সি.এন.এন পরিচালিত তাৎক্ষণিক জরিপে এগিয়ে রয়েছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারী ক্লিনটন। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ ভোটার হিলারীকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং ৩৪ শতাংশ ভোটার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন। ৯ অক্টোবরের বিতর্কই ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য বাঁচা মরার লড়াই। নারীদের প্রতি তাঁর আপত্তিকর ভিডিও টি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প তীব্র নিন্দা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। নিজ দলের শীর্ষ নেতারাও তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। কেউ কেউ ট্রাম্পকে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোরও অনুরোধ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এতটা বিদ্বেষপূর্ণ টেলিভিশন বিতর্ক এর আগে কখনো দেখা যায়নি। ১৯ অক্টোবরের শেষ বিতর্কেও হেরে গেছেন ট্রাম্প।  তাৎক্ষণিক জরিপে দর্শকদের ৫২ শতাংশ হিলারী ও ৩৯ শতাংশ ট্রাম্পকে জয়ী মনে করেন। পরাজিত হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রত্যাখানের ইঙ্গিত দিয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময় ঘোষণা করেছেন নির্বাচনী ফলাফল তিনি অবশ্যই মেনে নিবেন যদি সে নির্বাচনে তাঁর জয় হয়। ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় হিলারী জানান, ট্রাম্প আমাদের গণতন্ত্রকে কলংকিত করেছেন, অবমাননা করেছেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্টরী এন্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অধ্যাপকও মার্কিন প্রেসিডেন্টদের নিয়ে কয়েকটি গ্রন্থ প্রণেতা অধ্যাপক জুলিয়ান জিলজার বলেন আগের দুটি বিতর্কের তুলনায় হিলারী ক্লিনটন তাঁর সর্বোচ্চ পারফর্ম করেছেন। আক্রমনের প্রতিটি সুযোগ তিনি কাজে লাগিয়েছেন। নারী অধিকার ও অভিবাসন প্রসঙ্গে আলোচনার সময় হিলারীকে বেশ জ্ঞানী ও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। ধনকুবের ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকে মুসলমান, শরণার্থী, অভিবাসী সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে আসছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় হিলারীকেই যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। ট্রাম্প সম্পর্কে গণমাধ্যমে যে সমস্ত খবর প্রকাশিত হচ্ছে তাতে মনে হয় একটি নিরাপদ পৃথিবীর প্রত্যাশায় ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রত্যাখানের সম্ভাবনাই বেশী। ট্রাম্প নারীদের বিরুদ্ধে অশ্লিল মন্তব্য করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ইমিগ্রেন্টদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের কথাও তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, তাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে প্রতীয়মান হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু কিছু মন্তব্য বর্ণবাদী, মানবতা বিরোধী, সাম্প্রদায়িক, অযৌক্তিক এবং হাস্যকর।

ইংরেজ মহাকবি মিল্টনের একটি বিখ্যাত উক্তি এখানে বেশ প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি Ò Childhood shows the man as morning shows the dayÓ।  একটি সমাজ কতটা সভ্য তা নিরুপিত হয় সেই সমাজে সংখ্যালঘু মানুষদের নিরাপত্তা আছে কিনা তার উপর। একটি দেশ কতটা গণতান্ত্রিক তা নিরুপিত হয় সেই দেশে ভিন্নমতকে গ্রাহ্য করা হয় কি-না তার উপর এবং করলেও কতটুকু করা হয় তার উপর। সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট(সিপিজে) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তা হবে গণমাধ্যমের জন্য হুমকি। এজন্য সাংবাদিকদের ভয়ানক ফল ভোগ করতে হতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতা পাওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প গণমাধ্যমের উপর চড়াও হয়েছেন, গণমাধ্যমকে তিনি অসৎ বলে সম্বোধন করেছেন। সাংবাদিকদের অধিকারের উপর ট্রাম্পের আক্রমণকে নজিরবিহীন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বিশ্ব বিপদে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন। ১২ অক্টোবর জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে জেইদ বলেন এরই মধ্যে ট্রাম্প যা বলেছেন তার ভিত্তিতে যদি তিনি নির্বাচিত হন এবং সেগুলো পরিবর্তন না করেন তাহলে নি:সন্দেহে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন থেকে বিপজ্জনক হবে বলে আমি মনে করি। জাতিসংঘের হাই কমিশনার আরও বলেছেন বিশেষ কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক প্রচারে হস্তক্ষেপ করতে তিনি আগ্রহী নন। তবে কোনো দেশের নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে যদি নির্যাতন বাড়ে, অসহায় জনগোষ্ঠি যদি মানবাধিকার বঞ্চিত হয় সেক্ষেত্রে তাকে কথা বলতেই হবে। ট্রাম্প অভিযুক্ত অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদে পানিতে মুখ ডুবিয়ে নির্যাতনের (ওয়াটার বোর্ডিং) চেয়েও ভয়ংকর ব্যবস্থা চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। অথচ বিনা বিচারে কোনো মানুষকে নিষ্ঠুর অমানবিক শাস্তি দেয়া মানবাধিকারের চরম লংঘন বলেই বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরই মধ্যে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন, একাধিক জরিপ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী আগাম ভোটে এগিয়ে রয়েছেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারী ক্লিনটন। আরলি ভোটিং নামের আগাম ভোটের ব্যবস্থা গত চারটি নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বারাক ওবামার জয়ের পেছনেও এই আগাম ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’ দেশটির আসন্ন নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারী ক্লিনটনের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন চমৎকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে হিলারী ক্লিনটনের। আর আমরা তাঁর প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন ব্যক্ত করছি। হিলারীকে তারা বলেছেন তিনি কাজকর্মে নাছোরবান্দা, সহানুভূতিশীল এবং সপ্রতিভ। সম্পাদকীয়তে বলা হয় হিলারী ক্লিনটন সারা বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে জানেন। ওবামা প্রশাসনের ভেতরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ। পাশাপাশি রিপাবলিকান পদপার্থী ট্রাম্প সম্পর্কে বলা হয়েছে ট্রাম্প ভয়ানক, প্রেসিডেন্ট পদপার্থী হিসেবে তিনি অসম্ভব রকমের অযোগ্য। পত্রিকাটি হিলারীর কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প হিলারীর শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় হিলারী ১১২টি দেশ সফরের অভিজ্ঞতা, পুরো বিশ্বে দেশের জন্য নতুন সুযোগ খোঁজা  ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সক্ষমতার বিষয়ে জবাব দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে হিলারী কতটা সবল তার চেয়েও বিবেচ্য বিষয় হলো ট্রাম্প অত্যন্ত দুর্বল এটা নি:সন্দেহে বলা যায়। হিলারীর সীমাবদ্ধতাগুলোকে ট্রাম্প কোনো অবস্থাতেই কাজে লাগাতে পারবেন না বলে প্রতীয়মান হয়। নিজের দুর্বলতার আড়ালে সেগুলো চাপা পড়ে যাবে। প্রত্যাশা করা যায় হিলারীই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পতœী সাবেক ফাস্ট লেডী হিলারী ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছেন বলে মনে হয় পৃথিবীর কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষ।  লেখক-ব্যাংকার ও কলামিস্ট এবং সভাপতি ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com