যাদু-টুনা (সিহর): ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম-(কোরআন-হাদিস ও বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা)
বশির আহমদ : ভূমিকা-বর্তমান সমাজে যাদু-টুনা বা সিহর এক ভয়াবহ ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। হিংসা, প্রতিশোধ বা ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে বহু মানুষ যাদু করায় বা করে থাকে; যা ইসলামের আলোকে কঠিন হারাম ও কুফরির কাছাকাছি অপরাধ। এই প্রবণতাকে পুঁজি করে একদল কবিরাজ যাদু-টুনাকে রুজির মাধ্যম বানিয়ে মানুষের জীবনকে ধ্বংস করছে। বাজারে কুফুরি যাদুর বই সহজলভ্য হওয়ায় সমাজে অপরাধ আরও বেড়ে গেছে। ইসলাম এসব কাজকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে।
কোরআনের আলোকে সিহরের বিধান:
১. সিহর শয়তানের শিক্ষা, কুফরির কাজ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَـٰكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ
‘সুলাইমান (আ.) কুফরি করেননি; বরং শয়তানরাই কুফরি করেছিল, তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত।’ (সূরা আল-বাকারা, ২:১০২)
এই আয়াত প্রমাণ করে: যাদু শয়তানদের শিক্ষা; যাদু শেখা, শেখানো বা করা কঠোরভাবে হারাম।
২. যাদুকর কখনো সফল হয় না
আল্লাহ বলেন, وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَىٰ
‘যাদুকর যেখানেই যাক, কখনো সফল হবে না।’ (সূরা ত্বাহা, ২০:৬৯)
এ আয়াত যাদুর নৈতিক ও আখিরাতি পরিণতি স্পষ্ট করে।
হাদিসের আলোকে সিহরের হুকুম:
১. সিহর-সাত ধ্বংসাত্মক গুনাহের একটি।
রাসুল (সাঃ,) বলেন, اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ
‘সাতটি ধ্বংসাত্মক গুনাহ থেকে দূরে থাকো।’
তিনি বলেন, الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَالسِّحْرُ…
‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা এবং যাদু…’ (বুখারি ৫৭৬৪, মুসলিম ৮৯)
২. অল্প যাদু শিখলেও শিরকের আশঙ্কা
রাসুল (সাঃ) বলেন, مَن تَعَلَّمَ شَيْئًا مِنَ السِّحْرِ قَلِيلًا أَوْ كَثِيرًا، فَقَدْ أَشْرَكَ
‘যে অল্প বা বেশি যাদুর কিছু শিখল, সে শিরকে লিপ্ত হলো।’ (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)
অন্যকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যাদু করা:
আমাদের সমাজে অনেক মানুষ শত্রুতা, হিংসা, দাম্পত্য ভাঙন বা ব্যবসা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাদু করায়। কুফুরি কালাম পড়ে, জিন-শয়তানের সাহায্য নিয়ে অন্যের ক্ষতি করা ইসলামে কঠোরতম অপরাধ। যে যাদু করে এবং যে করায়-উভয়েই একই অপরাধের অংশীদার। অনেক আলেমের মতে, তওবা ছাড়া যাদুকরের ইমান নিয়ে মৃত্যু অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
তাবিজ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা:
তাবিজ দুই ধরনের:
১. কোরআনের আয়াত, দোয়া, আল্লাহর নাম ভিত্তিক তাবিজ যদি তাতে কোনো কুফরি বা শিরকি শব্দ না থাকে এবং একান্তই কোরআনের আয়াত বা দোয়া লেখা হয়, তাহলে এ ধরনের তাবিজ দেওয়া অনেক ফকিহের মতে জায়েজ। কারণ কোরআন নিজেই শিফা, এবং সাহাবারা কখনো কখনো লিখিত দোয়া ব্যবহার করতেন।
২. কুফুরি কালাম, অজানা চিহ্ন, জিন/শয়তানের সাহায্যভিত্তিক তাবিজ। এগুলো সম্পূর্ণ হারাম এবং এতে শিরক, কুফরির আশঙ্কা প্রবল।
বর্তমান সময়ের সমস্যা হলো, বাজারে পাওয়া বেশিরভাগ তাবিজেই কুফুরি বর্ণ, জাদুর চিহ্ন, জিনের নাম, সংখ্যা-কোড ইত্যাদি থাকে। এগুলো সরাসরি শয়তানি তাবিজ এবং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
সিহর বা যাদুর কারণে সমাজে যে ভয়াবহতা তৈরি হয়েছে:
পরিবার ভাঙন, কলহ-বিবাদ বৃদ্ধি, ব্যবসা ও রুজিতে অশান্তি, মানসিক অস্থিরতা, রোগ-বালাই, যুবসমাজের নষ্ট হওয়া, অবিশ্বাস ও সন্দেহের পরিবেশ।
কবিরাজরা টাকা উপার্জনের লোভে মানুষের জীবন ধ্বংস করছে। সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার কারণে কুফুরি সেহরকারী ও যাদুকরদের কাছে ছুটছে-যা আরও বিপদের কারণ।
যাদুর চিকিৎসা-সুন্নাহর পদ্ধতি:
যাদুর চিকিৎসা করা সুন্নাহ। ইসলামে অনুমোদিত চিকিৎসা হলো রুকইয়াহ।
রাসুল (সাঃ) এর ওপর যাদু করা হলে আল্লাহ নাজিল করেন, সূরা ফালাক, সূরা নাস, যার মাধ্যমে রুকইয়াহ করা হয়। (বুখারি ৫৭৬৫)
রুকইয়াহর প্রধান উপাদান: সূরা ফালাক, সূরা নাস, আয়াতুল কুরসি, বিসমিল্লাহ দিয়ে ফুঁক দেওয়া, দোয়া-দরুদ। যাদুকর দিয়ে যাদু কাটানো কখনোই জায়েজ নয়; বরং কঠোরভাবে হারাম।
সমাজের করণীয়: যাদুকর ও কুফুরি তাবিজকারীদের চিহ্নিত করে সচেতন করা, লাইব্রেরি থেকে কুফুরি যাদুর বই অপসারণের দাবি তোলা, মসজিদ-মাদরাসায় সিহরের ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করা, পরিবারে ইসলামি শিক্ষা জোরদার করা, রুকইয়াহর প্রচার বাড়ানো, আল্লাহভীতি ও নৈতিকতা জাগ্রত করা।
উপসংহার
যাদু-টুনা কখনোই হালকা অপরাধ নয়। এটি ঈমান ধ্বংসকারী, সমাজ বিনষ্টকারী এবং আখেরাত বরবাদকারী কাজ। অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা, টাকার লোভ ও নফসের বশবর্তী হয়ে কেউ যেন এ বিপথে না যায়-এটাই মূল শিক্ষা।
আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন, হেদায়েত দিন এবং সিহরের সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
লেখক: বশির আহমদ, অধ্যক্ষ,উলুয়াইল ইসলামি।



মন্তব্য করুন