তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন—এখনো দূর্ঘটনার ভয় যাত্রী ও স্থানীয়দের রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেন দুর্ঘটনা

ইমাদ উদ দীন॥ তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে আসলো যাত্রী ও স্থানীয়দের উদ্বেগ উৎকন্ঠার বাস্তব চিত্র। কুলাউড়ায় উপবন ট্রেন দূর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর এমনটিই মনে করছেন এই রোডের রেল যাত্রী ও সচেতন মহল। সিলেট আখাউড়া রোডের রেলপথের স্থানীয়বাসিন্দা ও যাত্রীদের এখনো দূর্ঘটনার ভয় কাটছেনা। কারন দীর্ঘদিনের ত্রুটিযুক্ত ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন, ব্রিজ অনান্য যন্ত্রাংশ ও ট্রেনের কারণেই এই রোডে ঘটেচলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। ঘনঘন দুর্ঘটনায় এখনো চরম আতঙ্কে এ রোডের যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। চলতি বছরের ২৩ জুন জেলার কুলাউড়া উপজেলা বরমচাল ইউনিয়নের বড়ছড়া ব্রিজের উপর ঘটে যাওয়া উপবন এক্রপ্রেস ট্রেনের ভয়াবহ দূর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন ওই দূর্ঘটনা তদন্তে গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায় সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৃথক পৃথক ভাবে পেশকৃত ওই তদন্ত রিপোটে এই ভয়াবহ দূর্ঘটনাকে রক্ষণাবেক্ষণ, দীর্ঘদিনের সংস্কারহীনতা ও কর্তব্য কাজে গাফলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদন গুলোতে এই দূর্ঘটনার কারন ছাড়াও ভবিষ্যতে দূর্ঘটনা রোধে নানা সুপারিশও রেখেছেন তারা। ওই প্রতিবেদন গুলোর রিপোটের সাথে একমত পোষন করে স্থানীয় বাসিন্দা ও এ রোডের যাত্রীরা দূর্ঘটনা নিয়ে রয়েছেন শঙ্কায়। কারন চরম ঝুঁকিতে থাকা দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ এই রোডের রেললাইন,ট্রেন,বগি, ইঞ্জিন,স্টেশন,ছোট-বড় ব্রিজ, স্লিপার,ফিসপ্লেট,জয়েন্ট পয়েন্ট,হুক,নাট বল্টু, ক্লিপ ও সিগন্যাল সংস্কার কিংবা নতুন ভাবে নির্মাণ না হওয়াতে কিছুতেই কাটছেনা তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা। স্থানীয়দের তথ্য মতে মৌলভীবাজার জেলার ভেতর ভাটেরা থেকে সাতগাঁও পর্যন্ত শুধু কুলাউড়া অংশে একমাসেই ঘটেছে পাঁচটি দুর্ঘটনা। তবে এ পাঁচ দুর্ঘটনার ধরন ছিল একই। ত্রুটিপূর্ণ লাইন ও বগির কারণে লাইচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এ সব ট্রেন। দুর্ঘটনার কবলে পড়া ট্রেনগুলো হলো উপবন,পাহাড়িকা, জয়ন্তিকা ও কালনী। এরকম দৃশ্য বা ঘটনা এর আগে কখন দেখেননি স্থানীয় বাসিন্দারা এমনটি তারা দৃঢ় কন্ঠেই জানাচ্ছেন। এসব দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়সহ স্টেশনে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগও পোহাতে হয়। গতকাল ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়া কুলাউড়ার বরমচাল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপে তারা ক্ষোভের সাথে জানালেন শুধু ঠিকঠাক আছে রেল সড়ক। আর সবই শুধু নেই আর নেই। রেল লাইন,ফিসপ্লেট,ক্লিপ,হুক,স্লিপার,নাট,বল্টু,সিগন্যাল সহযোগি যন্ত্রাংশ সবই আছে কেবল নামমাত্রই। মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন,জরাজীর্ণ বগি,সিডিউল বির্পযয় এটা হল এঅঞ্চলের রেল বিভাগের চলমান ও দৃশ্যমান দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এ থেকে উত্তরণ কেবল আশ্বাসের ফুলঝুরি। দূর্ঘটনায় প্রাণহানী অঙ্গহানী কিছু দিন হৈ চৈ। তারপর সবই আগের মত যেই সেই। তারা জানালেন কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজ এলাকার উপবন ট্রেন দূর্ঘটনাস্থলের আশপাশে এখনো আছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ জরাজীর্ণ রেল লাইন। ত্যানা (পুরাতন কাপড়), সুতলি, প্লাষ্টিকের ব্যাগ দিয়ে আটকানো হয়েছে ফিসপ্লেট ও নাট বল্টু। অধিকাংশ স্থানে স্লিপারের সাথে রেল লাইন আটকানোর হুক ও ক্লিপ নেই। জয়েন্ট পয়েন্ট ও ক্রসিং পয়েন্টের ফিসপ্লেট ও নাট বল্টু থ্রেটহীন অকার্যকর। এককথায় এরকম সিলেট আখাউড়া রোড নাজুক অবস্থার রেল লাইন কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। তাদের জোর দাবি দ্রুত ত্রুটিপূর্ণ ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ রেল লাইন, ট্রেন, স্টেশন ও ব্রিজ মেরামত ও নির্মাণের। যাতে এই অঞ্চলের মানুষের ট্রেন যাত্রা হয় নিরাপদ।
দূর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোট:
সম্প্রতি ওই দূর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ে বিভাগের একধিক সুত্র। জানা যায় ওই তদন্ত রিপোটগুলোতে দূর্ঘটনার জন্য দায়ি ত্রুটিবিচ্যুতিসহ ভবিষ্যতে এধরনের দূর্ঘটনা রোধে নানা সুপারিশও করেছেন তারা। তদন্ত প্রতিবেদনের একটিতে বলা হয়েছে রেলপথ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছিল। এই প্রতিবেদন জমা দেয় ওই ঘটনায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। তারা জানায় এই ভয়াবহ দূর্ঘটনায় রেলওয়ের ২৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই দূর্ঘটনায় পাঁচ জনকে দায়ি করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া হয়েছে। ২৩ জুন রাতে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দ্যেশে ছেড়ে আসা ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া ব্রিজে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এসময় রেলপথের একটি ব্রিজ ভেঙে ২টি বগি ব্রিজের নীচে ও অন্য ৩টি বগি খাদের পাশে পড়ে ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ওই ভয়াবহ দূর্ঘটনায় চারজন নিহত ও প্রায় ৩ শতাধিক যাত্রী আহত হন। ওই ঘটনার পর রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি এবং বিভাগীয় এবং পাঁচ সদস্যের অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় বলেছে দূর্ঘটনাস্থলের রেলপথ ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে থাকা মহাব্যবস্থাপক, প্রধান প্রকৌশলী ও বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এই দূর্ঘটনার বিষয়ে তাদের দায় এড়াতে পারেন না। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে রেলওয়ের মহাপরিচালককে বলা হয়েছে। এদিকে মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে অপর তদন্ত কমিটি বলেছে ওই দুর্ঘটনায় যান্ত্রিক বিভাগের ২৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৭ টাকা, সিগন্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের ২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা এবং প্রকৌশলী বিভাগের ২ লাখ ৬ হাজার ৯০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয় মূলত দুর্ঘটনাস্থলের রেলপথ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব জায়গায় রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে দ্রুত সেগুলো মেরামত করা। ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ম্যানুয়েলের নির্দেশনা নিয়মিত এবং যথাযথভাবে সম্পাদন করা। আখাউড়া-সিলেট সেকশনে কর্মকর্তা পর্যায়ে নিয়মিত ট্রলি নিয়ে পরিদর্শন করে ত্রুটি শনাক্ত করা। মেরামত করাসহ সাত দফা সুপারিশও করেন তারা। এদিকে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি তিন দফা সুপারিশ করেছে। যেগুলো হলো বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন স্থান, সেতু, রেললাইন শনাক্ত করে ত্রুটিমুক্ত করা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ; ট্র্যাক ও কোচ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদগুলোর শূন্যপদে জরুরি জনবল নিয়োগ এবং ট্র্যাক ও কোচ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদনে দূর্ঘটনার জন্য ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (এসএসএই) মো: জুলহাস ও মেট (নির্দিষ্ট এলাকায় রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি) সাইফুল আলমকে দায়ি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন