সিলেট রেলপথে নতুন ট্রেন চালুসহ ৮ দাবিতে ৪ ঘন্টা অবরোধ-বিক্ষোভ
মাহফুজ শাকিল : সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-কক্সবাজার রেলপথে দুটি নতুন ট্রেন চালুসহ আট দফা দাবিতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশন স্টেশনসহ সিলেট-আখাউড়া রেলপথের বিভিন্ন স্টেশনে রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
শনিবার ১ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে এ কর্মসূচি শুরু হয়। রেলপথ অবরোধের কারণে সিলেট রেলপথের বিভিন্ন রেল স্টেশনে কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন আটকা পড়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ট্রেনযাত্রীরা।
আন্দোলনকারীদের ৮ দফার মধ্য ৬টি দাবি পূরণের আশ্বাসে প্রায় ৪ ঘণ্টা পর বেলা দুইটার দিকে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী নেতারা। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুলাউড়া রেলওয়ে রেস্ট হাউসে আন্দোলনকারী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে রেল সচিবের পক্ষে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মহব্বত জান চৌধুরী, ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আহসান হাবিব, কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন, কুলাউড়া থানার ওসি ওমর ফারুক, কুলাউড়া রেলের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর শাহাজান পাটোয়ারী। এসময় আন্দোলনকারীসহ জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে রেলের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা সিলেট রুটে সকল আন্তঃনগর ট্রেনে দুটি করে অতিরিক্ত বগি সংযোজন ও ট্রেনে উন্নত ইঞ্জিন স্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে সিলেট-আখাউড়া রেলপথের বন্ধ রেলস্টেশন চালু ও সিলেট-আখাউড়া সেকশনে দুটি লোকাল ট্রেন চালু করা হবে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে কুলাউড়া থেকে সিলেট রেল স্টেশন পর্যন্ত আন্তনগর পারাবত ট্রেনে ৬০ আসন বিশিষ্ট একটি বগি স্থায়ীভাবে দেওয়া হবে। তন্মধ্য কুলাউড়া জংশন স্টেশনে ৪০ ও শ্রীমঙ্গল স্টেশনে ২০টি আসন থাকবে। রেলের কর্মকর্তারা বলেছেন, সিলেট-আখাউড়া রেলপথ সংস্কারে ১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চলতি নভেম্বর মাসে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-কক্সবাজার রেলপথে দুটি নতুন ট্রেন চালু করার আশ্বাস দেন।
জানা গেছে, সিলেটের রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে শনিবার সকাল থেকেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন লাল পতাকা হাতে নিয়ে কুলাউড়া জংশন স্টেশনে জড়ো হতে থাকেন। এসময় আন্দোলনকারী দাবি আদায়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। কর্মসূচিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংবাদিক, পেশাজীবি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠনের লোকজন ব্যানার সম্বলিত খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে যোগ দেন তাঁরা। এসময় আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আজিজুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও মূখ্য সমন্বয়ক এম আতিকুর রহমান আখই ও সাংবাদিক নাজমুল বারী সোহেলের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য নওয়াব আলী আব্বাছ খান, জাতীয়তাবাদী আইনজীবি ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এডভোকেট আবেদ রাজা, জামায়াতে ইসলামীর মৌলভীবাজার জেলার আমির ইঞ্জিনিয়ার সাহেদ আলী, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল হক খান সাহেদ, উপজেলা বিএনপির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সজল, বিএনপি নেতা রেদওয়ান খাঁন, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মো. জাকির হোসেন, ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এড. জসিম উদ্দিন আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টি উপজেলা শাখার সভাপতি কমরেড আব্দুল লতিফ, ইসলামী আন্দোলনের জেলা কমিটির সেক্রেটারী মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, জাসদ নেতা আব্দুল হান্নান, সিনিয়র সাংবাদিক খালেদ পারভেজ বখ্শ, মু. ইমাদ উদ-দীন, মোক্তাদির হোসেন, মাহফুজ শাকিল, পরিবহন শ্রমিক নেতা ইসলাম উদ্দিন জ্ঞানী, আলমাছ পারভেজ তালুকদার প্রমুখ। বক্তারা বলেন, সিলেট-ঢাকা রেলপথে দ্রুতগামী ট্রেনের অভাব, পর্যাপ্ত টিকিট না পাওয়া, ট্রেনের ঘনঘন বিলম্ব এবং পুরোনো বগি ব্যবহারের কারণে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে আছেন। অনেক জায়গায় রেললাইন বেহাল অবস্থায় আছে। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। রেলপথ সংস্কার না হলে একসময় পুরো অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। একপর্যায়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্ঠা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা জানিয়ে বলেন, ‘সিলেট বিভাগ রেল, সড়ক যোগাযোগসহ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে কুলাউড়ার পাশাপাশি সিলেটের মানুষও জেগে উঠেছেন। রেলের আট দফা দাবি যৌক্তিক। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়া যাবে না।’
আট দফা দাবিগুলো হলো, ঢাকা-সিলেট রেলপথে অনুমোদিত টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস দ্রুত চালুসহ সিলেট-ঢাকা, সিলেট-কক্সবাজার রেলপথে দুটি স্পেশাল ট্রেন চালু; আখাউড়া-সিলেট রেলপথ সংস্কার ও ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে উন্নীতকরণ; আখাউড়া-সিলেট সেকশনে একটি লোকাল ট্রেন চালু; আখাউড়া-সিলেট সেকশনে সব বন্ধ স্টেশন চালু; কুলাউড়া জংশন ও শ্রীমঙ্গল স্টেশনে বরাদ্দকৃত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি; সিলেট-ঢাকাগামী আন্তনগর কালনী ও পারাবত ট্রেনের আযমপুরের পর ঢাকা অভিমুখী সব স্টেশনের যাত্রাবিরতি প্রত্যাহার; সিলেটের সঙ্গে চলাচলকারী ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় রোধে ত্রুটিমুক্ত ইঞ্জিন যুক্ত এবং যাত্রীদের চাহিদা অনুপাতে প্রতিটি ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজন করা।
কুলাউড়া স্টেশনের স্টেশন মাস্টার রোমান আহমদ বলেন, অবরোধের কারণে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন প্রথমে ঢাকা মগবাজার রেলগেইট, শায়েস্তাগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল স্টেশনে আটকা পড়ে। অবরোধ শুরুর আগে সকাল সাড়ে সাতটায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেন কুলাউড়া স্টেশন ছেড়ে যায়। তিনি আরো বলেন, অবরোধের কারণে চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন সকাল সাড়ে দশটায় ছেড়ে যাবার কথা থাকলেও বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ার কারণে দুপুর আড়াইটার দিকে কুলাউড়া স্টেশনে পৌঁছে। অন্যদিকে সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন কুলাউড়া থেকে সকাল সাড়ে এগোরটায় যাবার কথা থাকলেও দুপুর আড়াইটার দিকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মহিউদ্দিন বলেন, আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন দাবির বিষয়ে কুলাউড়ায় রেলওয়ে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। যৌক্তিক দাবির মধ্যে বেশিরভাগ দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় আন্দোলনকারীরা দুপুর ২টার দিকে অবরোধ তুলে নেন। পরে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। বাকি দাবিগুলো পর্যায়ক্রমে মেনে নেয়া হবে রেলওয়ের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ জানান।
আন্দোলনকারী সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সিলেট অঞ্চলের রেলপথের বেহাল অবস্থা দূর করতে এবং যাত্রীসেবার মানোন্নয়নের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর কুলাউড়ায় অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে আন্দোলনকারীরা ট্রেন আটকালে রেলওয়ের ঢাকা অঞ্চলের ডিআরএম মো. মহিউদ্দিন আরিফ ১৫ দিনের মধ্যে দাবি মেনে নেবার আশ্বাস দেন। এরপর গত ১০ অক্টোবর কুলাউড়া জংশন স্টেশনের ভিআইপি ওয়েটিং রুমে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন রেলওয়ের ঢাকা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. মহিউদ্দিন আরিফ। বৈঠকে মহিউদ্দিন আরিফের আশ্বাসকে প্রত্যাখান করে আন্দোলনকারীরা ৩১ অক্টোবরের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে ১ নভেম্বর অবরোধের ঘোষণা দেন।



মন্তব্য করুন