হযরতুল-আল্লামা-আলহাজ্ব-আব্দুল-কাইয়ূম-সিদ্দিকী-(রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

August 18, 2021,

স্টাফ রিপোর্টার॥ মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা আব্দুল কাইয়ূম সিদ্দিকী (রহ.) ছিলেন একজন সুপরিচিত আলেমে দ্বীন। শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ) এর অন্যতম খলিফা, বিস্ময়কয় প্রতিভার অধিকারী, দক্ষ প্রশাসক, সত্যের পথে নির্বিক আদর্শ এক মর্দে মোজাহিদ । তার জীবন ছিল বহুমাত্রিক ও সৃজনশীল । তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যতিক্রমধর্মী বহুমাত্রীক প্রতিভা যিনি ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, সমাজচিন্তা. রাষ্ট্রনীতি, নৈতিকতা, জীবন ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ইসলামী জ্ঞান সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন এক পরিপূর্ণ মহীরূহ ও অনুপম জীবনাদর্শের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
অধ্যক্ষ আল্লামা আব্দুল কাইয়ূম সিদ্দিকী (রহ.) ১৯৫৬ সালের ১লা ডিসেম্বর সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার মুড়াউল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন । উনার পিতা পীরে কামেল আল্লামা মুদ্দাসসির আলী নকশবন্ধী (রহ.)ছিলেন তৎকালীন সময়ে একজন উচুঁ মাপের আলেম। উনার মাতার নাম জহুরা খাতুন একজন মহিয়সী নারী ছিলেন । কাসিদায়ে বুরদা , কাসিদায়ে নুমান ইত্যাদি মোবারক কাসিদা উনার মুখস্ত ছিল । আধ্যাতিকতায় পরিপূর্ণ একজন পরহেজগার রমনী ছিলেন।
আল্লামা মুদ্দাসসির আলী নকশবন্ধী (রহ.) এর ৮ ছেলে এবং ২ মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৮ম সন্তান।
পিতার প্রতিষ্ঠিত মক্তব ও হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে পিতার হাত ধরেই প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষা শুরু করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি সুজাউল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন । সুজাউল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ইসলামি জ্ঞান অন্বেষণের পিপাসা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী রাখালগঞ্জ দারুল কোরআন মাদ্রাসায় ভর্তি হন । ১৯৬৮ সালে এই মাদরাসা থেকে প্রথম বিভাগে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
১৯৭০ সালে সৎপুর দারুল হাদিস কামিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭২ সালে কমলগঞ্জ সফাত আলী ফাজিল মাদরাসা থেকে ফাজিল কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭২ সালে তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এবং সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে কামিল (হাদিস) কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে তিনি এইচএসসি পাস করেন ।
১৯৭৬ সালে শামছুল উলামা আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহ.) এর কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন । ১৯৮৮ সালে শামছুল উলামা আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহ.) এর কাছ থেকে ইলমে তরিকতের খেলাফত লাভ করেন । তরিকতের খেলাফতের লাভের পর তিনি নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে উনার বাসায় খানকা পরিচালনা করতেরন। সিলেটে বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় তিনি খানকার মহান দায়িত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
সাত বার তিনি হজ্ব ও উমরা পালন করেছিলেন। তিনি রাসুলে কারীম (সা.) এর বংশধর শায়খ আলয়ী (রহ.) এর কাছ থেকে শায়খুল হাদিস উপাধি লাভ করেন।
ঈদের নামাজের ইমামতি করেছেন গ্রামতলা ঈদগাহ বড়লেখা, উওর মুলাইম ঈদগাহ মৌলভীবাজার ও মৌলভীবাজার সদরে টাউন ঈদগাহের তিনটি জামায়াতের প্রথম জামাতে।পরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করে ঈদের নামাজের ইমামতি করা থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন।
নিজ গ্রামের ঈদগাহ উনার মাধ্যমে পুনঃ নির্মাণ হয়েছে ও জামে মসজিদ পুনঃ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
কর্মজীবনে উনি ১৯৭৪ সালে কামিল পাশ করার পর দ্বীন ইসলামের প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে ১৯৭৪ সালেই শ্রীমঙ্গল আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসায় সহকারী মৌলভী হিসাবে যোগদান করেন। অত্যন্ত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং সুনামের সাথে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সেখানে ইলমের মহান দায়িত্ব পালন করেন।
অতপর ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে আল্লামা আব্দুল কাইয়ূম সিদ্দিকী (রহ.) ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী বিদ্যাপীঠ মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদ্রাসায় প্রথমে সুপার পদে যোগদান করেছিলেন । এবং উনার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি কামিল স্তরে উন্নীত হয়। উনার জীবনের তীলে তীলে গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানটি সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছিল।
প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিল্ডিং উনার মবকুল খেদমতের নীরব স্বাক্ষী হয়ে আজও দাড়িঁয়ে আছে । সুদীর্ঘ ৩৪ বছর অত্যন্ত সুনাম ও নিষ্ঠার সাথে এই মহান দায়িত্ব পালন করে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর গ্রহন করেন। ২০০০ সালে তিনি সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
পাশাপাশি তিনি জমিয়তুল মোদাররিসিন বাংলাদেশ এর দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন । বাংলাদেশ আঞ্জুমানের মাদারিসে আরাবিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ দিন আঞ্জুমানে আল ইসলাহ মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। এবং মৃত্যু অবধি আঞ্জুমানে আল ইসলাহ বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৭৭ সালে শ্রীমঙ্গল আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসায় ইলমে কিরাতের খেদমত শুরু করেন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সেখানে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলীর খেতমতে ছিলেন । ১৯৮২ সাল থেকে মৃত্যু অবধি মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদ্রাসায় দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলীর নাজিমের দায়িত্ব পালন করেন । মৌলভীবাজার পশ্চিমবাজার জামে মসজিদে প্রতি রমজান মাসে বাদ যোহর নিয়মিত কোরআনুল কারীমের তাফসির পেশ করতেন । সেখানে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোরআনুল কারীমের অমীয় সূধা পান করতে কোরআন কারীমের প্রেমিকরা জড়ো হতেন। অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি।
বিশেষ করে উনার বয়ান ছিল হৃদয়গ্রায়ী। যেকোনো মানুষ সহজে উনার কথা উপলব্ধি করতে পারতো । সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় রসালো ভাবে বয়ান করতেন । বর্হিবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তিনি প্রচুর মাহফিল করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইংল্যান্ড,আমেরিকা ইত্যাদি দেশ ছিল উল্লেখ যোগ্য।
১৯৮২ সালের ২রা নভেম্বর নবীগঞ্জ ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান পরিবারের সাথে বৈবাহিক বন্ধনের আবদ্ধ হন। তিনি ৩ মেয়ে ৩ ছেলের গর্বিত পিতা। তিন মেয়েই বিবাহিত। ১ম মেয়ে লন্ডন প্রবাসী, ২য় মেয়ে দেশে, ৩য় মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী । ১ম ছেলে তানজিম আহমদ সিদ্দিকী লন্ডন প্রবাসী (বিবাহিত), ২য় ছেলে তাফহিম আহমদ সিদ্দিকী ব্যারিস্টারী লেখাপড়ায় অধ্যয়নরত এবং ৩য় ছেলে তামজিদ আহমদ সিদ্দিকী কামিল (হাদিস) বিভাগে অধ্যয়নরত।
এই মহান বুযুর্গ তিনি সব সময় দোয়া করতেন উনার যেনে ভালো কোন চাঁদের শুক্রবার মৃত্যু হয় । আল্লাহ তা’লা উনার সেই দু’য়া কবুল করেন। মুহাররাম মাসের প্রথম শুক্রবার ১৩ আগষ্ঠ ২০২১ খ্রীষ্টাব্দ রাত ১.৩০ মিনিটে লাখো লাখো ছাত্র, মুহিুব্বনের চোখের জলে সিক্ত হয়ে মাওলায়ে হাক্বিকির সানিধ্যে চলে যান।
আল্লাহ তা’লা উনার কবরকে জান্নাতুল ফেরদাউস বানিয়ে দেন।-আমিন।
লেখক ঃ মাওলানা মোঃ আব্দুল মোক্তাদির হোসাইন সিদ্দিকী (মরহুমের ভাতিজা) প্রভাষক, (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) জগৎসী জি.কে.এম. সাইফুর রহমান কলেজ, মৌলভীবাজার।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com