সৈয়দ মহসীন আলীর স্মরণ আত্ম মগ্নতার বেদীমূলে
সরওয়ার আহমদ॥ নিজেকে নিয়ে ব্যাকুল থাকার নামই হচ্ছে আত্ম মগ্নতা। এটি এমন এক উপসর্গ যার প্রভাবে মদ্যপ যেমন বুঁদ হয়ে থাকে তেমনি আত্ম মগ্নতার ব্যামো ব্যক্তি, সমাজ এবং সংগঠনকে বিড়ম্বিত করে। স্বকীয় দৃষ্টিকোণকে দৃষ্টিহীনতার আবরণে ঢেকে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না। ফলশ্রুতিতে এই অন্ধত্বের কুয়াশাচ্ছন্নতায় বিবর্ণ হয়ে যায় অতীত, বৃত্তবন্দী হয় বর্তমান এবং ভবির্ষ্যত হয়ে উটে কুহেলিকাময়। উল্লেখিত সূচনা কথার নেপথ্য উদগার বা সুঁড় সুঁড়ির যৎকিঞ্চিত বিবরণ এইখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
মৌলভীবাজারের মাটি ও মানুষের নেতা প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর ৭ম মৃত্যু বার্ষি কী উপলক্ষে গত ১৭ই সিপ্টেম্বর মন্ত্রীর বাড়িতে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিলো। এই স্মরণ সভাতে উপস্থিত থাকার জন্য ১৫ তারিখ রাতে ভাবী (প্রয়াত মন্ত্রীর স্ত্রী সৈয়দা সায়েরা মহসীন) আমাকে ফোনে দাওয়াত দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য বঙ্গবন্ধুর উচ্চমার্গে আরোহণের নেপথ্যে যেমনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের যতিহীন অভিনিবেশ ছিলো তেমনি প্রান্তিক জনপদ মৌলভীবাজারের নেতা হয়ে উঠার ক্ষেত্রে সৈয়দ মহসীন আলীর পেছনে সায়রা মহসীনের অবদান কেও অস্বীকার করা যাবে না। তাই ভাবীর দাওয়াত কে উপক্ষা না করে সর্বোপরি সৈয়দ মহসীন আলীর প্রতি দুর্নিবার অনুবাগের টানে যথাসময়ে (বিকেল তিনটায়) স্মরণ সভায় উপস্থিত হয়েছিলাম।
স্মরণ সভার উদ্যেক্তা ছিলেন মন্ত্রী তনয়া সৈয়দা সানজিদা মহসীন ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের অন্যতম নেত্রী। একারণে কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সিলেট এবং হবিগঞ্জের যুব নেতাদের আগমন ঘটে ছিলো। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একাংশও স্মরণ সভায় এসেছিলেন। অন্য অংশের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি ছিলো না। রাজনৈতিক জিগাংসা বোধ হয় মৃত্যুর পরও বিদ্যমান থাকে!
স্মরণ সভায় বক্তার সংখ্যা কম থাকে। প্রয়াত ব্যক্তির জীবনালেখ্য নিয়ে সারগর্ভ মূল্যায়ন এবং স্মৃতি নির্ভর বক্তব্যের রজত রেখায় দর্শক ও শ্রেতাম-লী সিক্ত হন। কিন্তু এখানে ছিলো তার ব্যতিক্রম। বসে থাকা পর্যন্ত ১৭ জন বক্তার নামের তালিকা করেছিলাম। পরবর্তীতে আরো কতজন যুক্ত হয়েছিলেন, জানি না। পাশে বসে থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মতিউর রহমান মতিন সভার সভানেত্রী এবং সঞ্চালক কে হাত ইসারায় এবং ইঙ্গিতে আমাকে দেখিয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য সুযোগ কামনা করছিলো। টের পেয়ে আমি থাকে ধমক দিয়ে বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম ওরা হয়তো ভাবছেন আমি তোমাকে প্ররোচিত করছি। তাকে বলেছিলাম, পাকিস্তান আমলে সৈয়দ মহসীন আলী যখন গভর্ণমেন্ট স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র তখন আমি একই স্কুলে ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়ি। তাই তাকে নিয়ে স্মৃতি মন্থনে সময়ের প্রয়োজন। মতিন বলছিলো, সিনিয়র সাংবাদিক হিসাবে মহসীন আলী কে নিয়ে আপনার কথা বলার অধিকার আছে। আমি বলেছিলাম অধিকারের বিষয়টি এখানে গৌণ। এখানে হয়তো অন্য কিছু আছে। ৭০ সন থেকে আওয়ামী দর্শনে প্রভাবিত থাকলেও সাংবাদিক হিসাবে কোন কোন প্রেক্ষাপটে বিরোধীতা করেছি। তাছাড়া বক্তা হিসাবে কখনও নীলকণ্ট হয়ে উঠি। চাঁছাছোঁলা বক্তব্যে অনেকের আঁতে ঘাঁ লাগে। অন্যদিকে কনুইমারা শুধু মাঠে নয় মঞ্চেও ছুটে এসেছে। এ কণুই মারার কবলে হয়তো আমি ও পড়েছি। তবে ঘোষক যে দয়াপরবশ হয়ে মাইকে আমার উপস্থিতির কথা ঘোষণা করেছেন এটাই বড় প্রাপ্তি। আমার কথা শুনে মতিন জব্দ হয়ে গিয়েছিলো।
স্মরণ সভা আছরের নামাজের আগে শুরু হয়েছিলো। একারণে আছরের নামাজ কাজা করেছি। মাগরিবের আজান যখন ধ্বনিত হলো তখন আর বসে থাকতে পারিনি। স্থান ত্যাগের আগে অনুজপ্রতীম মতিন কে বলেছিলামÑ রাজনীতির ঝা-া হাতে নিয়ে এদেশে অনেকে শুধু আঙ্গুল পুলে কলা গাছ হননি, বট গাছেও রুপান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন তার ব্যতিক্রম। রাজনীতির কণ্ঠকাকীর্ণ মাঠে নেমে তিনি পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছেন, এমন কি দেউলিয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। অবশ্য একথাটি একাধিক বক্তা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এদেশের সংসদীয় ইতিহাসে যে তিনি একটি নজির সৃষ্টি করেছেন সেকথাটি কেউ বলেনি। ১৯৭৯ সনের সংসদে তৎকালীন সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ৪৮ মিনিট ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছিলেন। ২০১৪ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের সংসদীয় অধীবেশনে স্পীকারের অনুমতি সাপেক্ষে মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী টানা ৩২ মিনিট অনর্গল ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণ শুনে প্রবীন পার্লামেন্টারিয়ান তুফায়েল আহমদ বলেছিলেনÑ মহসীন যে এত সুন্দর ইংরেজি বলতে পারে তা তো আগে জানতাম না। এই হচ্ছেন সৈয়দ মহসীন আলী। বৈঠকে বা রাজনৈতিক আড্ডায় তার মুখে সেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের ডায়লগ কিংবা পলিটিক্যাল ফিলোসপার প্লাটোর রিপাবলিক গ্রন্থের উদৃত্তি যারা শুনেছেন তারা অভিভূত হয়েছেন।
এই স্মরণ সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা যুবলীগের সভাপতি এবং প্রয়াত সাবেক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমানে ভাতিজা নাহিদ আহমদ। তিনি খেদকরে বলেছেন, দলীয় ভাবে তার চাচার মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয় না। পারিবারিক ভাবে সাবেক এই গণপরিষদ নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের কা-ারীর মৃত্যু বাষির্কী পালিত হয়। একই অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন সৈয়দ মহসীন আলীর তনয়া সৈয়দা সানজিদা মহসীন। বিষ্মরণের আওতায় কেবল এই দুই নেতা নন, আরও আছেন। পঞ্চাশের দশকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ ছিলেন কুলাউড়ার বীমাবিদ মুহিবুস সামাদ চৌধুরী। ৫৪ সনের নির্বাচনে কুলাউড়া বড়লেখা আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে জনাব চৌধুরী মুসলীম লীগ প্রার্থী এবং আসাম প্রাদেশিক সরকারের সাবেক কৃষি মন্ত্রী নবাব আলী হায়দার খান কে পরাজিত করে এম.এল.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই এলাকার কৃতিসন্তান বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটি অন্যতম সদস্য, সাবেক গণ পরিষদের সদস্য ও রাষ্ট্রদূত এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ব্যারিষ্টার আব্দুল মুনতাকিম চৌধুরীর কৃতিত্বও কমছিলোনা। এই দুই নেতার কথা হালআমলের নেতৃবৃন্দ বেমালুম ভুলে গেছেন। তারা হয়েছেন স্মরণের অতীত। বিষ্মৃতির ছাইপাশে ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন মো. ইলিয়াস। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং জেলা আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কা-ারি এ নেতা কখনও নিজের আখের গোছান নি। বরং দুটি নির্বাচন কালে শ্রীমঙ্গলের নিজের ভিটা বিক্রি করেছেন। যথোচিত ভাবে স্মরণের বরণডালায় অভিষিক্ত হন না তিনি। কুলাউড়ার মাটি ও মানুষের নেতা সাবেক এমপি আব্দুল জব্বারের মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয় পারিবারিক উদ্যেগে। দল এবং দেশের জন্য যারা জীবনের সুবর্ণ সময় হেলায় বিসর্জন দিয়েছেন, বৈরী ভ্রƒকুটি উপেক্ষা করে যারা অগ্রপথিকের ভূমিকায় রাজনৈতিক পথ পরিক্রমণ করেছেন, সময়ের পালাবদলে তারা বোধ হয় অবহেলিত এবং উপেক্ষিত। উত্তর সুরিদের আত্ম মগ্নতা তথা নিজেদের কে নিয়ে ব্যাকুল থাকার নিরাভরণ ফলশ্রুতি হচ্ছে এই অতীত বিমুখতা। কিন্তু কবি গুরু তার জবাব দিয়েছেন বহু আগেÑ হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছো অপমান/অপমানে একদিন হতে হবে তাদের সবার সমান। স্মরণ সভা থেকে চলে আসার প্রাক্কালে দূর থেকে মসুদ আহমদের বক্তব্য ভেসে আসচ্ছিলো। তাঁর বক্তব্যেও তদ্রুপ অনুরণ ছিলো।… আপনারা আজ যাদের অবহেলা করছেন মৃত্যুর পর তেমনি আপনারা ও অবহেলিত থাকবেন, কেউ আপনাদের কথা স্মরণ করবে না। এটাই বোধহয় নিয়তির আমোঘ বিধান।



মন্তব্য করুন