আইনগত সহায়তা : অসহায় মানুষের সামাজিক ও ন্যায়বিচারের নিরাপত্তা

July 4, 2017,

মোঃ জসীম উদ্দীন॥
ভূমিকা :  ৫০০ কোটি বছর বয়সী এ পৃথিবীর জনসংখ্যা বর্তমানে ৭২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আজ থেকে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম যখন মনুষ্য আকৃতির প্রাণীর আবির্ভাব ঘটলো মূলত তখন থেকেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে অন্যান্য হাজারো প্রজাতির জীবের সাথে আদি মানবেরা অগণিত প্রজন্ম ধরে নিজেদের চাহিদা পূরণ ও আবাস ভাগাভাগি করে নেয়ার মানসে নিজেদের মধ্যে নানান দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লো। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আবার আপোষ ও সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হলো আদি বিচার ব্যবস্থার, যা কালক্রমে নতুন নতুন সভ্যতা ও রাষ্ট্রের গোড়া পত্তনের ধারাবাহিকতায় রূপ নিলো আধুনিক বিচার ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থায় গোড়া থেকেই ধণিক সম্প্রদায় অর্থ ও প্রতিপত্তির কারণে নিজেদের অস্তিত্বকে জোরালোভাবে টিকিয়ে রাখতে সম্ভব হয়েছে। পক্ষান্তরে দরিদ্র জনগোষ্ঠী মামলায় টিকে থাকতে না পেরে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিয়েছে।
‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’-এ কথা যেমন সত্যি আবার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ যে কত অসহায় হয়ে পড়ে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো কোন মানুষের মামলায় জড়িয়ে পড়া। মামলার প্রতিযোগিতায় যেখানে অনেক ধনকুবের নিঃস্ব হয়ে যান সেখানে দরিদ্র মানুষের অবস্থা তো আরো অসহনীয়। অনেক দরিদ্র আবার শোষিত ও নির্যাতিত হওয়ার পরও অর্থের অভাবে অন্যায়কে মেনে নিয়ে মামলা থেকে দূরে থাকেন। দরিদ্র মানুষের চাহিদার এ জায়গাটি অভাবনীয়ভাবে পূরণ করছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা। সরকার অক্ষম, অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে একটি নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে এনে ইতোমধ্যে ২৮টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৪২টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আইনগত সহায়তা প্রদান এর অন্তভূর্ক্ত না হলেও অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যে তা সামাজিক নিরাপত্তার এক আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট :
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে সরকারি খরচে আইনি সহায়তার পদ্ধতি চালু আছে। রাষ্ট্রের শতভাগ মানুষ যাতে আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে পারে, সেজন্যে এই ব্যবস্থা রাখা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদে (আইসিসিপিআর) বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি আইনের বা আদালতের আশ্রয় নিতে চান অথচ তার আর্থিক সামর্থ নেই, তবে ওই ব্যক্তিকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার বাধ্য থাকবে। ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে অধিকার সম্পর্কিত যে ২৫টি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে তার ৬টি অনুচ্ছেদে সরাসরি বিচারের অধিকারের সাথে সম্পর্কিত, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে আইনি সহায়তা শুরুর কথা :
সমগ্র বাংলাদেশে সরকারি আইন সহায়তা কার্যμম পরিচালনার জন্য বর্তমান সরকার ইতিপূর্বে ক্ষমতায় থাকাকালে আজ থেকে ১৪ বছর আগে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানা আর্থ-সামাজিক কারণে অসমর্থদের আইনি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০’ পাস করা হয় এবং পরবর্তীতে একটি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা ২৮ এপ্রিল, ২০০০ থেকে এ আইন কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করা হয় এবং আইনের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’  নামের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়।  এর আগে ১৯৯৪ ও ১৯৯৭ সালে রেজুশেনের মাধ্যমে দুইবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও আইনগত সহায়তাকে প্রাতিষ্ঠানিককরণ করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই সংস্থার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই করা যায়নি। ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সংস্থাটিকে বছরে ৫০ লাখ টাকা করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হতো। অথচ তার মাত্র তিন শতাংশও খরচ হতো না। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথম একে একটি সক্ষম ও কার্যকরি সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
সংস্থা পরিচালনার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৯ সদস্যের একটি জাতীয় পরিচালনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। জেলা জজের সমমানের পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে এই সংস্থার পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। সংস্থার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জেলা কমিটির কার্যাবলি তদারক ও নিয়ন্ত্রণ এবং আইনগত সহায়তা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার এবং আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা নিরূপন। সংস্থার অধীনে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটির মাধ্যমে সারা দেশে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জেলা ও দায়রা জজ জেলা কমিটির চেয়ারম্যান ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে সদস্য-সচিব কওে প্রতিটি জেলায় একটি কওে জেলা কমিটি গঠিত হয়। ২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সদস্য-সচিব করে উপজেলা কমিটি এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন সচিবকে সদস্য-সচিব করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার একটি ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়।
সারা দেশে প্রায় ৪ হাজার প্যানেল আইনজীবী জেলা কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হতদরিদ্র মানুষের মামলা পরিচালনা করছেন। ২০০৯ সালে আইন সহায়তা গ্রহীতার সংখ্যা ছিল ৯১৬০ জন , ২০১০ সালে ১১২৬৬জন, ২০১১ সালে ১২৫৬৮ জন, ২০১২ সালে ১৫৪৫০ জন, ২০১৩ সালে ১৯৪৯৩জন, ২০১৪ সালে ২৫২৮৩ জন এবং ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৪০৯ জনে। নিস্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল ৩৫৭১টি যা ২০১০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬২৭টিতে। ২০১১ সালে ও ২০১২ সালে কিছুটা ছন্দপতন ঘটলেও ২০১৩ সাল থেকে নিস্পত্তির হার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসে। ২০১১-২০১৫ এই ৫ বছর নিস্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৩৭৬, ৪৪৩৬, ৫৬৩১, ৯৩৭৭ এবং ১২৪১৬টি।
সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ যেমন-সিডা, জিআইজেড, ইউএসআইডি, ইউএনডিপি, মানুষের জন্যে ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্র্যাক, ব্লাস্ট, নারী প্রগতি, মহিলা পরিষদ, মানবাধিকার সংস্থা, যুব উন্নয়ন একাডেমি ইত্যাদি বিচার বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন, কারাগার, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ঠ ক্ষেত্রে কারাবন্দীদের সহায়তা, বিরোধ নিস্পত্তি ও বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস :
জনগনকে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০’ কার্যকরের তারিখ অর্থাৎ ২৮ এপ্রিলকে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জনগনকে সচেতন করার পাশাপাশি এর আরো প্রধান তিনটি উদ্দেশ্য হলো-দরিদ্র ও অসহায় জনগণের ন্যায় বিচারে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, সরকারি আইনসেবা কার্যক্রমকে আরো কার্যকর, বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা এবং সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আইন সহায়তা কার্যক্রম আরো গতিশীল ও কার্যকর করা। ২০১৩ সাল থেকে আইন সেবার মূলমন্ত্র সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে যথাযথ মর্যাদায় বাংলাদেশের সকল জেলায় উৎসবমূখর পরিবেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
সুগঠিত হলো আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ :
আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ -কে যুগোপযোগী, শক্তিশালী ও দরিদ্রবান্ধব করার লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়নের পর  থেকে বিভিন্ন সময়ে নি¤েœাক্ত নীতিমালা, বিধিমালা ও প্রবিধানমালা গ্রহণ করা হয়েছে :
১.                  ২০১১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১১ প্রণয়ন।
২.                 ২০১৩ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) আইন, ২০১৩ (সুপ্রীম কোর্ট কমিটি গঠন ও কার্যাবলী প্রণয়ন।
৩.                ২০১৪ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪ প্রণয়ন।
৪.                  ২০১৫ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন।
৫.                 ২০১৫ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫ প্রণয়ন।
৬.                ২০১৬ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (চৌকি আদালত বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১৬ প্রণয়ন।
৭.                  ২০১৬ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (শ্রম আদালত বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১৬ প্রণয়ন।
যেসব মামলায় সরকারি আইনি সহায়তা প্রদান করা হয় :
ফৌজদারি মামলা:
স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে স্বামীর বিয়ে, শারীরিক নির্যাতন, যৌতুক দাবী বা যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, পাচার, অপহরণ, ধর্ষণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটক বা গ্রেফতার।
দেওয়ানি মামলা:
সন্তানের অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ ও দেনমোহর আদায়, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার, দলিল বাতিল, স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, সম্পত্তির বন্টন বা বাটোয়ারা, ঘোষণামূলক মামলা এবং চুক্তি সংক্রান্ত মামলা।
যেসব বিষয়ে আইনি সহায়তা প্রদান করা হয়:
১.                  বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ।
২.                 মামলা পরিচালনার জন্যে আইনজীবী নিয়োগ।
৩.                আইনজীবীর ফি পরিশোধ।
৪.                  মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানী পরিশোধ।
৫.                 বিনামূল্যে আদেশের রায় কিংবা অনুলিপি সরবরাহ।
৬.                ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ।
৭.                  ফৌজদারি মামলায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ।
৮.                 মামলার সাথে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় পরিশোধ।
আইনি পরামর্শ:
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার অধীন প্রত্যেকটা জেলায় লিগ্যাল এইড অফিস আছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের দায়িত্বে আছেন একজন লিগ্যাল এইড অফিসার, যিনি সিনিয়র সহকারি জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। এছাড়া সরকারি খরচে দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের মামলা পরিচালনার জন্য প্রত্যেকটি জেলায় এডভোকেটগণের একটি প্যানেল রয়েছে। লিগ্যাল এইড অফিসার এবং প্যানেলভুক্ত এডভোকেটগণ লিগ্যাল এইড অফিস ব্যবস্থাপনা ও সরকারি অর্থায়নে মামলা পরিচালনার পাশাপাশি বিনা খরচে দরিদ্র বিচার প্রার্থীগণকে আইনি পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।
বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিস্পত্তি (এডিআর) :
উন্নত বিশ্বে এখন আদালতে মামলা করার চেয়ে আদালতের বাইরে বিরোধ নিস্পত্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও বর্তমানে লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত পরামর্শের পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আপোষযোগ্য বিরোধ (মামলা দায়েরের পূর্বে) ও মামলা (মামলা দায়েরের পরে) মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিস্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। ২০১৫ সালে বিধি প্রজ্ঞাপন হওয়ার পর এ পর্যন্ত  ১৭ জন পূর্ণকালীন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ১৭টি জেলায় ৭৪২ টি বিরোধ বিকল্প পদ্ধতিতে মিমাংসার (এডিআর) উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং ৫২৬টি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং সফলভাবে এডিআর করার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষদের ৬৮,০১,৪০০/-(আটষট্টিলক্ষ একহাজার চারশত) টাকা আদায় করে দিতে সমর্থ হয়েছেন।
সরকারি আইন সহায়তা তহবিল শতভাগ ব্যয় :
বর্তমান সরকারের বিগত ৬ বছরে সরকারি আইন সহায়তা কার্যμমের ব্যাপক অগ্রগতির ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত তহবিলের ব্যয় অভাবনীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালের পূর্বে সরকারি আইন সহায়তা তহবিলের ব্যয় ১০ শতাংশেরও কম ছিল, যা ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ শতাংশ, ২০১০ সালে ৮৬ শতাংশ, ২০১১ সালে ৯৮ শতাংশ, ২০১২ সালে শতভাগ এবং সর্বশেষ ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের এ তহবিলের ব্যয় শতভাগে উন্নীত হয়েছে, বর্তমানে ও আগের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সংস্থার কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার আগামী ৫ বছরের (২০১২-২০১৭) কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচি চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়নের জন্য একটি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্যানেল আইনজীবীর ফি বৃদ্ধি:
দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীগণকে সরকারি আইন সহায়তার আওতায় মামলা পরিচালনায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আইনগত সহায়তা প্রবিধানমালা, ২০১৫ জারী করার মাধ্যমে আইনজীবীগণের ফি এর হার বহুলাংশে বর্ধিত করা হয়েছে। আইনজীবীগণের ফি এর হার বৃদ্ধির ফলে প্যানেল আইনজীবীগণের মধ্যে ব্যাপক কর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রমিক আইন সহায়তা সেল চালু :
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস, ২০১৩ এর অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের আইনগত সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকার শ্রম ভবনে শ্রমিক আইন সহায়তা সেল চালু করা হয়। এই সেলের মাধ্যমে শ্রমিকদেরকে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে আইনি সেবা প্রদান করা হয়। এই সেলের মাধ্যমে দরিদ্র  অসহায় শ্রমিক ২০১৩ হতে ২০১৫ সাল
পর্যন্ত ২১,০৩,৭৯২/-(একুশ লক্ষ তিন হাজার সাতশত বিরানব্বই) টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে। ২৬ জন শ্রমিক চাকুরীতে পুর্নবহাল হয়েছে। এই সেলের মাধ্যমে দরিদ্র শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের আইনি সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
যোগাযোগ :
অসহায় ও দরিদ্র জনগণকে আইনগত পরামর্শসহ তথ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে হটলাইন সার্ভিস চালুর পাশাপাশি সংস্থার সেবাধর্মী কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজড করার জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। ০১৭৬১২২২২২২, ০১৭৬১২২২২২২ এবং ০১৭৬১২২২২২২ এই তিনটি হটলাইন নাম্বারে যে কোন সময় ফোন করে যে কোন সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে এবং িি.িহষধংড়.মড়া.নফ এই ওয়েবসাইটে লগইন করে যে কোন প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। হটলাইন চালু হবার পর ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ১৫২৫২ জনকে প্রাথমিক আইনি পরামর্শ ও তথ্য সেবা প্রদান করা হয়েছে। আইনি সহায়তার টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন ১৬৪৩০
সুযোগ পাবে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ :
আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা ২০১৪ এর বিধি-২ এর আওতায় যে সব ব্যক্তিগণকে আইনি সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে সেটা দেখলেই বোঝা যায় দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যে এই সংস্থা আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে। যারা বিনামূল্যে এই আইনি সহায়তা পাবে :
(১) অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যাদের বার্ষিক গড় আয় সুপ্রীম কোর্টে আইনগত সহায়তার ক্ষেত্রে
১৫০০০০/-টাকা এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে ১০০০০০/- টাকার বেশি নয়।
(২)  কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম বা কর্মহীন কোন ব্যক্তি।
(৩) বার্ষিক ১,৫০,০০০/- টাকার ঊর্দ্ধে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা।
(৪) কোন শ্রমিক যাহার বার্ষিক গড় আয় ১০০০০০/- টাকার বেশি নয়।
(৫) কোন শিশু।
(৬) মানব পাচারের শিকার কোন ব্যক্তি।
(৭) শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু।
(৮) নিরাশ্রয় ব্যক্তি বা ভবঘুরে।
(৯) পারিবারিক সহিংসতার শিকার বা সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছেন এইরূপ কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি।
(১০)  বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন কোন ব্যক্তি।
(১১)  ভিজিডি কার্ডধারী দুঃস্থ মাতা।
(১২)  দুর্বৃত্ত দ্বারা এসিড দগ্ধ নারী বা শিশু।
(১৩)  আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দ প্রাপ্ত ব্যক্তি।
(১৪)  অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুঃস্থ মহিলা।
(১৫)  প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
(১৬) আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ ব্যক্তি।
(১৭) বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল।
(১৮) আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যক্তি।
(১৯) জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে সুপারিশকৃত বা বিবেচিত ব্যাক্তি।
আইনগত সহায়তা : মৌলভীবাজার প্রেক্ষিত
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মৌলভীবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনগত সহায়তা প্রদানে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপনের পর থেকে মে ২০১৭ পর্যন্ত জেলা কমিটির ১১১টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৩ সালে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার যোগদানের পর থেকে এর কার্যক্রমে আসে আরো গতিশীলতা। তৃণমূল পর্যায়ে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৌলভীবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। এ সকল সভায় জেলা ও দায়রা জজ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি সদস্যবৃন্দ, আইনজীবীবৃন্দ, উপজেলা ও ইউনিয়ন লিগ্যাল কমিটির সদস্যবৃন্দ, সহযোগি সংস্থার সদস্যবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
এপ্রিল ২০১৭ এর শুরুতে ফৌজদারি, দেওয়ানি, পারিবারিক ও অন্যান্য মামলার সংখ্যা ছিল ১২১১টি। তন্মধ্যে রায় হয়েছে ৪টি, ডিসচার্জ হয়েছে ২টি, বিকল্প পদ্ধতিতে নিস্পত্তি হয়েছে ১টি, অনুপস্থিতির কারণে ডিফল্ট হয়েছে ৩টি, আদালতের বাইরে নিস্পত্তি হয়েছে ২টি, বাতিল ২টি ও অন্যান্য ১টি সহ ১৮টি মামলা নিস্পত্তি হয়েছে এবং অবশিষ্ঠ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১১৯৩টি। মৌলভীবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেলভুক্ত আইনজীবীর সংখ্যা বর্তমানে ৪১ জনে (পুরুষ-৩৭ জন, নারী-০৪ জন) উন্নীত হয়েছে। ২০১৬ সালে আইনজীবী ফি পরিশোধ, ডিএনএ টেস্ট ফি, জেলা ব্যাপী প্রচারণা ও অন্যান্য খরচসহ সর্বমোট ৩,৮১,০৫০ টাকা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস কর্তৃক পরিশোধ করা হয়েছে। সহযোগি সংস্থা ইউএসআইডির সহযোগিতায় ৩টি কর্মশালা পরিচালিত হয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী, কমিটির সদস্য এবং প্যানেল আইনজীবীবৃন্দের জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে ২০১৩ সালে শুরু হবার পর থেকে র‌্যালী, আলোচনা সভা, সেরা প্যানেল আইনজীবীকে স্বীকৃতি প্রদান, স্টল প্রদর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটিকা প্রদর্শনসহ নানা ধরণের কর্মসূচির মাধ্যমে  প্রতি বছর অত্যন্ত জাকজমকভাবে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হচ্ছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে ‘বাতায়ন’ নামে সুদৃশ্য একটি স্মরণিকাও বের করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় চৌকি আদালত নামে একটি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে। উপজেলার দরিদ্র
জনগণের জন্য সরকারি আইনগত সহায়তা সেবাগুলো এই চৌকি আদালত থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। চৌকি আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীর নিকট থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করে প্রযোজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে দাখিল করতে হয়। প্রয়োজনে চৌকি আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সাথেও সাক্ষাৎ করার বিধান রয়েছে। প্রয়োজনে এই আদালতের হটলাইন ০১৮১৩-৭০৬০৬০ এই নম্বরেও যোগাযোগ করা যাবে।
কার্যক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ এবং সুপারিশ সমূহ :
সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যাযবিচার প্রতিষ্ঠায় আইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর বাস্তবায়নে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। নি¤েœ সুপারিশের আলোকে এগুলো উল্লেখ করা হলো:

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com