কমরেড আবদুল হক’র ৩০ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
স্টাফ রিপোর্টার : সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড আবদুল হক-এর ৩০-তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২২ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় শহরের চৌমুহনাস্থ ¬কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভাপতিত্ব করেন জেলা এনডিএফ’র সহ-সভাপতি মো: নুরুল মোহাইমীন। আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মো: সোহেল, ধ্রবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো: শাহিন মিয়া, মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো: জসিমউদ্দিন প্রমূখ।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, কমরেড আবদুল হক’র মৃত্যুবার্ষিকী আমরা এমন এক সময়ে পালন করছি যখন, পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাজার-প্রভাববলয় পুনর্বণ্টন নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত সামগ্রিক গুরুত্বের প্রেক্ষিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য এবং প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী চীন-রাশিয়া এদেশকে স্ব স্ব পক্ষে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের দালাল নয়াঔপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী ভারতের ভূমিকাও ক্রিয়াশীল। অন্তর্বতী সরকার প্রভু মার্কিনের স্বার্থে মানবিক করিডোর প্রদানের পাঁয়তারা, ঢাকায় মানবাধিকার কমিশনের অফিস করা, স্টারলিংকের সাথে সংযুক্ত হওয়া; এনডিএ চুক্তি করে চট্টগ্রাম বন্দরসহ লালদিয়া, পানগাঁও ইত্যাদি বন্দরসমূহ বিভিন্ন মেয়াদে বিদেশীদের লিজ দেওয়া; মার্কিনের শুল্ক প্রশ্নে বেশি দামে কৃষিপণ্য আমদানি, এলএনজি, বোয়িং ক্রয়ের মত জাতীয় স্বার্থবিরোধী একাধিক চুক্তি করে চলেছে। একই সাথে বিপর্যস্ত অর্থনীতি আরো গভীর হয়ে সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্প কল-কারখানায় সংকট ও বেকারত্ব বৃদ্ধি, কৃষিতে উৎপাদন খরচের চেয়ে উৎপাদিত পণ্যের দাম কম পাওয়া, শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সংকট বৃদ্ধি পাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি ইত্যাদি শ্রমিক-কৃষক-জনগণের দুরাবস্থাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে চলেছে।
আলোচনা সভায় বক্তারা দেশের আইন শৃঙ্খলাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তারা বলে সরকার জনগণের জানমাল রক্ষায় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের জনগণ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। যখন তখন মানুষকে গুলি করে হত্যা, এমন কি পিটিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে জনসম্মুখে আগুণে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। ইতিপূর্বে কবর থেকে লাশ উঠিয়েও আগুণে পুড়ানো হয়। যাকে খুশী তাকে বিভিন্ন রকম ট্যাগ দিয়ে দেশে অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে। দেশে কোন সরকার আছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে না।
পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় বাজার ও প্রভাববলয় পুণর্বন্টন প্রশ্নে আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে বাংলাদেশসহ এতদাঞ্চলকে নিয়ে চলা তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিস্থিতি ঘোলা করে সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য পুরণে সচেষ্ট। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল সংযোগ সেতু এবং প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের সংযোগকারী মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেমন তার প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে চায় তেমনই সাম্রাজ্যবাদী চীন ও রাশিয়া তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর রয়েছে। বাজার পুণর্বন্টন ও প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে এতদ্বাঞ্চলে সম্ভাব্য আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী উভয়পক্ষ স্বপক্ষভুক্ত করে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শাণিত করে সাম্রাজ্যবাদী অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল শক্তি ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা। তাহলেই কেবল কমরেড আবদুল হকের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব হবে।
সভায় বক্তারা বলেন কমরেড আবদুল হক উপমহাদেশ তথা এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শুধু একটি নামই নয় বরং তিনি হচ্ছেন এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে এক অগ্রসেনানী, মহান দৃষ্টান্তস্থাপনকারী এক উজ্জল নক্ষত্র। ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ-গর্বাচেভ, তিনবিশ্ব তত্ত্ব, মাও সেতুং চিন্তাধারা ও মাওবাদ মার্কা সংশোধনবাদসহ সকল রূপের সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রতিষ্ঠায় কমরেড আবদুল হক অনন্য ভূমিকা পালন করেন। কমরেড আবদুল হক ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশোর জেলার সদর থানার খড়কিতে এক সম্ভ্রান্ত সামন্ত পীর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অথচ সেই সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই তিনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সামন্তবাদী পীর পরিবার থেকে আগত হলেও তিনি যখন কলকাতায় পড়াশুনা করতেন সেই ছাত্রাবস্থায় তিনি ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং শ্রমিক এবং শ্রমিকশ্রেণির মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈপ্লবিক কর্মকান্ড শুরু করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে বি.এ অনার্স পড়ার সময় তিনি ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী সভ্যপদ লাভ করেন। ১৯৪১ সালেই যশোর জেলার বনগাঁয়ে তৃতীয় কৃষক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এই সম্মেলনে “লাঙ্গল যার জমি তার” এবং ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাকিন্তান আমলে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পুর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশের সময়কালে ১৯৩৯ সালে হলওয়ের মনুমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলন, ১৯৪২ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন, হাটের তোলা আদায় বন্ধ আন্দোলন, ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন ও গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭১ এ যুদ্ধ ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন ইত্যাদি আন্দোলনে তিনি দৃষ্ঠান্তস্থাপনকারী ভূমিকা পালন করেন। এই সাম্রগ্রিক সময়কালে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে অগ্রণী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সংশোধনবাদের সকল প্রকাশের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের লাল পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম থেকেই আদর্শগত সংগ্রাম চালান। সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ চক্রের বিরুদ্ধে এই আদর্শগত সংগ্রামের সঠিকতা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। ‘সমাজতন্ত্র ব্যর্থ’ সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের এই প্রচার অভিযানের ঝড় যখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কালজয়ী ভাবাদর্শ উৎপাটিত করতে প্রবাহিত তখন কমরেড আবদুল হক একজন দৃঢ় মাকর্সবাদী-লেনিনবাদীর মত অটল অবিচল ছিলেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবী আশাবাদ ও তৎপরতায় উজ্জল। কমরেড আবদুল হক ছিলেন সুবক্তা। তাঁর উদ্দীপক বক্তৃতা প্রতিটি জনসভাকে উদ্দীপ্ত করত। ১৯৭০সালের ২০ জানুয়ারী আসাদ দিবসে ভাসানী ন্যাপ আয়োজিত ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রকাশ্যে শেষ জনসভা। লেখক হিসেবে কমরেড আবদুল হক ক্ষুরধার লেখনির অধিকারী ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দশ। এগুলো হচ্ছে ঃ ১. ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র, ২. ক্ষুধা হইতে মুক্তির পথ, ৩. যত রক্ত তত ডলার, ৪. পূর্ব বাংলা আধাউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী, ৫. কৃষি ব্যবস্থা আধাসামন্ততান্ত্রিক, ৬. মার্কসীয় দর্শন, ৭. সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ-১, ৮.সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ-২, ৯. বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতি ও ১০. মাওসেতুং এর মূল্যায়ন। এই দশটি গ্রন্থের সমন্বয়ে কমরেড আবদুল হক গ্রন্থাবলী পুণপ্রকাশ হচ্ছে। এছাড়াও কমরেড আবদুল হক-এর ১০০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটির উদ্যোগে ঢাকা হতে একটির স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সুদীর্ঘ ষাট বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে পঁচিশ বছরই তাকে আত্মগোপনে কাটাতে হয়। ২২ ডিসেম্বর ১৯৯৫ শুক্রবার রাত ১০টা ৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত অসুস্থ্যতায় ৭৫ বছর বয়সে আত্মগোপনে থেকে কমরেড আবদুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।



মন্তব্য করুন