হাতুড়ে ডাক্তারের ছড়াছড়ি
হোসাইন আহমদ॥ মৌলভীবাজারে হাতুড়ে ডাক্তারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। জেলার ৬৭টি ইউনিয়নে প্রায় তিন শতাধিক হাতুড়ে ডাক্তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এসব ডাক্তার রোগীকে দেখেই কোনো পরীক্ষা ছাড়া বলে দিতে পারেন রোগের নাম। ফুটপাতে বা একটি ফার্মেসীতে বসে কোনো ডাক্তারী যন্ত্রপাতি ছাড়াই এই অদ্ভুত নিয়মে রোগী দেখছেন নামধারী এসব ডাক্তাররা।
চিকিৎসার জন্য তারা দিতে পারেন সকল রোগের ওষুধ। পেটে ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, অর্শ, আমাশয়, পাইলস, মহিলাদের নানা রকমের জটিল রোগসহ যৌন রোগের ওষুধ পর্যন্তও দিতে সক্ষম ওই সকল হাতুড়ে ডাক্তাররা।
তারা কার্ড ও প্যাডে নামের আগে ‘ডাক্তার’ শব্দটি বসিয়েছেন। কেউ লিখেছেন ‘অভিজ্ঞ’, আবার কেউ লিখেছেন বিশেষজ্ঞ। সাথে সাথে লাগিয়েছেন নানা ডিগ্রি। অথচ এদের কারো পেশাচর্চার অনুমোদন নেই। এরপরও তারা প্রশাসনের নাকের ডগায় চালিয়ে যাচ্ছেন ভুয়া চিকিৎসা। অভিযোগ রয়েছে জেলা ড্রাগ সুপার তাদের কাছ থেকে মাসোরা আদায় করেন। যে পল্লী চিকিৎসক মাসোরা দেন না তার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে বড় অংকের জরিমানাও আদায় করেন ড্রাগ পুসার।
মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এ্যাক্ট আইন ২০১০ অনুযায়ী এমবিবিএস/ডেন্টাল পাশ করে বিএমডিসির অনুমতি নিয়ে নামের সামনে ডাক্তার লেখা যাবে। বিএমডিসির অনুমতি না নিয়ে এমবিবিএস/ডেন্টাল পাশ করেও নামের সামনে ডাক্তার লেখার কোনো বিধান নেই। কিন্তু মৌলভীবাজার জেলায় তিন শতাধিক হাতুড়ে ডাক্তার স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নামের সামনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লিখে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এই রমরমা বাণিজ্য। বিশেষ করে তাদের এই বাণিজ্যের স্বীকার হচ্ছেন এলাকার সহজ সরল মানুষ।
জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও বড় বড় বাজারে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া শতাধিক ডাক্তারের তালিকা ইতি মধ্যে যুগান্তরের হাতে পৌঁছেছে। এ তালিকা থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে তাদের অনেকেরই লেখাপড়ার দৌড় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আবার কেউ কেউ ২১ দিনের আরএমপি অথবা ৬ মাসের এলএমএএফ ট্রেনিং নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে চিকিৎসা নামক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতি মধ্যে অনেক হাতুড়ে ডাক্তার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছেও পরিণত হয়েছেন। হয়েছেন গাড়ি বাড়ির মালিক।
একটি সূত্র জানায়, পৌর শহরের সিলেট রোডের বড়কাপন এলাকায় পরিতুশ দাশ গুপ্ত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি দীর্ঘ দিন মাহিন ফার্মেসীতে চাকুরী করেছেন। এক পর্যায়ে টাকার বিনিময়ে নকল ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট এনে নামের সামনে ডাক্তার শব্দ ব্যবহার করছেন। একই রোডের হোসেন কমিউনিটি সেন্টারের পাশে সালা উদ্দিন ২১ দিনের আরএমপি প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে নাশা ও পলিপের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। মানিক লাল দাসও ২১ দিনের ট্রেনিং নিয়ে নামের সামনে ডাক্তার লিখে রমরমা বাণিজ্য চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
তালিকা অনুসন্ধানে আরোও জানা যায়, এলএমএএফ প্রশিক্ষন নিয়ে নামের সামনে ডাক্তার লিখে রমরমা বাণিজ্য চালাচ্ছেন সেন্ট্রাল রোডের সীমন্ত চন্দ্র, ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকার মির্জা মাহবুব আলম চৌধুরী, জুগিডর এলাকার ছয়ফুল ইসলাম ও দেব ব্রত মিলু এবং আরএমপি ট্রেনিং নিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ বাজারে পুতুল, সাহেদ আলী ও এস কে গোস্বামী সহ অনেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সচেতন নাগরিক জানান, বেরীরচর এলাকার আবুল হোসেন সেনাবাহীনিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ডাক্তারের সহযোগী ছিলেন। পরবর্তীতে অবসরে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নামের সামনে ডাক্তার লিখে দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু দিন আগে প্রশাসনের ভয়ে নামের সামন থেকে ডাক্তার শব্দটি মুছে ফেলেন। একই এলাকায় শফিকুল ইসলাম শান্ত নাশা ও পাইলসের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে জেলা ব্যাপি প্রতারণা করে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। রোগীকে আকৃষ্ট করতে শহরের অলিতে গলিতে লাগিয়েছেন নানা রঙের পোষ্টার, লিফলেট, ব্যানার ও সাইন বোর্ড।
এভাবে হাতুড়ে ডাক্তারদের প্রতারণার স্বীকার হয়ে মৌলিক অধিকার চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মৌলভীবাজারের অনেক রোগী। ভুল চিকিৎসায় জীবন দিতে হয়েছে অনেক সহজ সরল সাধারণ মানুষকে। ভোগান্তিতে পড়েছেন এজেলার অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
জেলা ড্রাগ সুপার বাদল সিকদার মাসোরা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এবিষয়ে সিভিল সার্জন ডাঃ সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনো ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।



মন্তব্য করুন