মিথ্যা সংবাদ ও পাঠকের দায় /চটি সাংবাদিকতা ও পাঠকের দায়
মুনজের আহমদ চৌধুরী॥ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যে খবরগুলি লেখা আমার কাজ ছাপিয়ে দায়িত্ব,সে খবরগুলি লেখা হয় না।
যে খবরগুলি পজেটিভ, উৎসাহব্যাঞ্জক, অনুকরনীয়, সমাজের জন্য শিক্ষনীয়; সেগুলি লেখতে পারি না। কেননা ‘পাঠকের’ কাছে সেগুলোর লাইক,শেয়ার ও নিউজভ্যালু কম। এমন খবর পাঠক তুলনামূলক অনেক কম পড়েন বলে পত্রিকাগুলোরও আগ্রহ কম।
রাজনৈতিক সংঘাত,অভ্যন্তরীন কোন্দল,ব্যাক্তিগত ও সামাজিক অপরাধ, দুর্ঘটনা, গুজব আর সপ্নে পাওয়া বিশ্বস্ত সুত্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যতবানীর গল্প রির্পোট বা কলাম পাঠক পড়েন। সেকারনে পাঠকের মনন বা মানবিকতাকে তীক্ষভাবে স্পর্শ করবার ক্ষমতাসস্পন্ন লেখাগুলি সেভাবে প্রকাশ হয়না। এ কারনেই মৌলিক, চিন্তা ও চিত্তাকর্ষক লেখাগুলি অনুৎসাহে লেখক লেখছেন না। লেখলেও পাঠক সেগুলি সেভাবে পড়ছেন না।
লেখকের মূল কাজ লেখার মাধ্যমে সময় ও সমাজকে ধারন করা,জীবনকে সঞ্জীবিত করা। সাংবাদিকতার দায়িত্ব পাঠককে প্রকৃত সত্যটি জানানো। এখানে বলে রাখি,চোখের চাক্ষুস দেখার বাইরেও সত্য থাকে।
আবার,একজন লেখক বা সাংবাদিকের কাছে সংখ্যায় গরিষ্ট পাঠক যা প্রত্যাশা করবেন,লেখক বা সাংবাদিকের দায়িত্ব হয়ে দাড়ায়, পাঠকের প্রত্যাশা পূরন। কারন, লেখক বা সাংবাদিক তো পাঠক পড়বেন বলেই লেখেন।
পাঠকের দোষ দি-ই না। গুজব আর গসিপে পাঠক আসলে নিজের সমস্যাগুলো থেকে হয়ত একটু স্বস্তি,ক্ষনিকের পরিত্রান পেতে চান। রোজকার প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দৈন্য,দোলাচল আর হা-হুতাশে পাঠক আসলে মুহুর্তের মুক্তি খোজেঁন।
বিশ্বায়নের বৈশ্বিকতায় সংবাদ বা গনমাধ্যম যেমন শিল্পের খোলসে থেকেই পন্য হয়ে উঠেছে, তেমনি পাল্টেছে পাঠক-দর্শকের রুচীবোধও। পাল্টেছে দর্শক,পাঠকের মনোযোগ-একাগ্রতা আর ধৈর্য্য। ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করেন এখন ফেসবুকার দ্রুতলয়ে। খুব কম পাঠকই লিংকটি খুলে শেষবধি পড়েন। অন্যভাবে বললে,খুব কম সংখ্যক খবর,মিডিয়া বা লেখক তার লেখাটির শেষ অবধি পড়াবার মতোন সক্ষমতা রাখেন।
দুই,
অসৎ,রেডিশ সাংবাদিকতাকে রিজেক্ট করতে শিখতে হবে পাঠককে,পাল্টাতে হবে পড়বার রুচী। নাহলে ‘ভালগার’ কে নিউজ হিসেবে অনলাইনে বেচবার অপচর্চা বন্ধ হবে না। মুক্তবাজার পন্যনীতির যুগে সংবাদ এক অর্থে কনটেন্ট বা পন্য। অবশ্যই সাংবাদিকতার দায় অপরীসীম। কিন্তু, পাঠক এখানে সংবাদের ভোক্তা। সঙ্গত কারনে অসৎ সাংবাদিকতা,খবরের নামে মিথ্যাচার,চরিত্রহনন,গুজবের গজব বন্ধে পাঠকের দায়বদ্ধতার দায় থেকে যায়। সাংবাদিকতার নামে আমাদের এখনকার, এখানকার বেশিরভাগ সামাজিক সাইটগুলোতে লাইক শেয়ারের বাজারে চলছে, সাংঘাতিকতা। কিন্তু, এটাও তো সত্যি যতক্ষন পর্যন্ত খবরের নামে গুজব, চরিত্রহনন আর রগরগে খবরের পাঠক থাকবে, ততক্ষন সাংবাদিকতার নামে দুবৃর্ত্তরা কনটেন্ট বাজারে ছাড়তে-ই থাকবে। ‘নায়িকা জরিনার এ কি কান্ড ভিডিওসহ)’ অথবা তারেক বা জয়ের ‘গোপন জীবন’ ,ক্রিকেটার তাসকীনদের চরিত্রহননের মিথ্যাচারের লিংকগুলি পাঠককে এড়িয়ে যেতে হবে। অনেক নির্জলা মিথ্যে খবরে পাঠকের বিশ্বাস অর্জনে জুড়ে দেয়া হয় মিথ্যে বক্তব্য,বানোয়াট ভিডিও আর ছবি। তারপরও,আমাদের পাঠক এখন অনেক সচেতন। তারা বোঝেন,জানেন কোনটি খবর আর কোনটি গসিপ।
তারপরও মিথ্যে,উদ্দেশ্যমূলক,রগরগে খবরের লিংকে হুমড়ি খেয়ে পড়া বন্ধ করবেন না ততক্ষন পর্যন্ত অনলাইনের মুক্তপ্রবাহে চটি সাংবাদিকতা, এক কম্পিউটার এক চেয়ার,তিন মোবাইল এক সম্পাদক; সাংবাদিকতার সাংঘাতিক গতি রুখবে কে?
একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক দেশের একজন বড় উপন্যাসিক। অথচ সে পত্রিকার অনলাইনে ভাইরাল লাইক কমেন্টের নগ্ন চটিবাজির ব্যাপারে দায়িত্বশীলরা যেন ততটাই উন্নাসিক। শুধু সেই কন্ঠ নয়, কর্পোরেট কাগজের কন্ঠে কন্ঠে এখন হিটের আশায় হট গুজবের বাড়াবাড়িতে মত্ত। ডিআরপি তালিকার সরকার স্বীকৃত শীর্ষ কাগজগুলোর অনলাইনে খবরের নামে ভাইরাল ভাইরাসের ছড়াছড়ি। পাঠক কোথায় যাবেন ?
দেশে ২৩ টি টিভি চ্যানেল চলছে। সরকার চাইলে এক মুহুর্তে সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। দেশে কোন সম্প্রচার নীতিমালা না থাকলেও ৫৭ ধারার সংবাদ হত্যার সরকারী থাবা আছে। অথচ কপি পেষ্ট সাংঘাতিকতা,রগরগে চটিবাজি,চরিত্রহননের বিকৃতি দেখবার কেউ নেই।
পাঠকের পড়বার ধারাও পাল্টাতে হবে। অশ্লীল, অমৌলিক,নকল চলচিত্রকে বর্জনের মাধ্যমে দর্শক স্বাগত জানান, জানাচ্ছেন সুস্থ ধারার ভালো চলচিত্রকে। এখানেও অসৎ,রেডিশ সাংবাদিকতাকে বর্জন করার দায়টুকু পাঠককে নিতে হবে।
পাশাপাশি সংবাদকে নয় সাংবাদিকতাকে পন্য বানানোর অপধারা বন্ধ করতে হবে। সরকারের উচিত শুধু রাজনৈতিক,নিজেদের দরকারী খবরে সেন্সরশীপ,বা সেল্ফ সেন্সরশীপের খগড় না চাপিয়ে অসৎ সাংবাদিকতা,ব্যাক্তি ও প্রতিষ্টানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা বন্ধে ব্যাবস্থা নেয়া। না হলে আইন, নীতিমালা, নসিহত দিয়ে সাংবাদিকতাকে গনমানুষের করা যাবে না। যাবে না অসুস্থ ধারাটিকে পরিহার করা। ভালো কিছুর জন্য পাঠক বা দর্শক স্বাগত জানাবেন, সেটা তাদেঁর দায়িত্ব। তেমনি খারাপটিকে বর্জনও করতে হবে। আবার এটাও সত্য,গুজবের গজব সরবরাহক অনলাইনগুলো আছে বলেই পাঠক সত্য খবরটি জানতে চোখ রাখেন তার বিশ্বস্ত অনলাইন বা পত্রিকাটিতে।
পাঠক হিসেবে পরস্ত্রীকাতর না হয়ে পরস্ত্রীমুগ্ধ হবার চেষ্টা করি আমি। কিন্তু কোন নিউজ পাঠানোর পর কর্মস্থল বাংলা ট্রিবিউনে আপ ( প্রকাশিত) হবার দশ মিনিটের মধ্যে শুরু হয় কপি-পেষ্ট। এক কম্পিউটার,দুই চেয়ার কপিপেষ্টের .ল ছা. ডটকম (ক্ষমা করবেন পাঠক) আর এদের সম্পাদক নামধারী কপিবাজদের চৌর্যবৃত্তির যে দৌরাত্ব সেটা কপিরাইট আইন বন্ধ করতে পারে না। বন্ধ করা দুরূহ জানি।
তবুও বলি ইতিবাচক খবরের পাঠক না বাড়লে নিউজভাল্যুর ডেফিনেশন পাল্টাবে না।
পাঠক-দর্শক পাল্টালে খবরওয়ালাদের না পাল্টে উপায় নেই।



মন্তব্য করুন