অনুসন্ধানী প্রতিবেদন শ্রীমঙ্গলে ইয়াবা সম্রাট ‘আল-আমিন’ এর নেশার স্বর্গরাজ্য
সাইফুল ইসলাম॥ মৌলভীবাজারের জেলার শ্রীমঙ্গলে শাপলাবাগ রেলক্রসিং এলাকার রেললাইনে দু,পাশের ইয়াবা সম্রাট-স¤্রাজ্ঞীদের নেশার স্বর্গরাজ্য পরিণিত হয়েছে। শহরের ছোট-বড় মিলে প্রায় ২০/২৫টি স্পটে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মাদক বাণিজ্য চলে অথ্যাৎ ইয়াবা,গাঁজা ও ফেন্সিডিলের।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সিন্দুরখান ইউনিয়নের কুঞ্জবন সীমান্ত। অন্যদিকে জেলার কুরমা ও ধলই ও চাতলাপুর,মরইছড়া ও লাতু-বাল্লা সীমান্ত। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা নিকটে থাকায় মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে পর্যটন এলাকা শ্রীমঙ্গল ব্যবহার করা হচ্ছে।
এদিকে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে গত ২২ ফেব্রুয়ারী ৪৫ পিচ ইয়াবা দিয়ে ৪জনকে আটক করা হয়েছে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারী ৮২ পিচ ইয়াবা ও তিন বোতল ফেন্সিডিলসহ তিনজনেেক গ্রেফতার করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০ লিটার দেশীয়ও মদসহ একজনকে আটক করা হয়েছে। আবার সর্বশেষ ২৭ ফেব্রুয়ারী ১২ পিচ ইয়াবাসহ শাপলাবাগ এলাকা থেকে ২জনকে আটক করা হয়েছে। তবে পুলিশের এ অভিযানকে লোক দেখানো বলে মনে করছেন বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লার সচেতন মহলরা।
মাদক সম্রাট আর স¤্জ্ঞীদের লক্ষাধিক টাকার মুনাফা,বিলাসী জীবন। আইন প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা গুলোর ব্যর্থ সফল অভিযান। ক’দিন পরেই আসামীরা খালাস। প্রধান হোতারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এটিই দেশের বাস্তবতা।
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান আল-আমিন ওরফে সুমনও তার পরিবার এবং নারী স¤্রাজ্ঞী মিলি বেগম।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে মাদক ব্যবসায়ী সম্রাট হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত ডাকাত আল-আমিন ওরফে সুমনের কাছে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এলাকার বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন তার নিজস্ব বাহিনী।
ইয়াবার ব্যবসায়ীর মধ্যে ইয়াবা সম্রাট আল-আমিন ওরফে সুমনের নামে শ্রীমঙ্গল থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় রয়েছে একাধিক ডাকাতি ও মাদকের মামলা।
কিন্তু দিব্যি এলাকায় অবস্থান নিয়ে গোপন আস্তানায় বসে মাদকের নিয়ন্ত্রণ করছেন আল-আমিন ওরফে সুমন। সে এলাকায় অবস্থান করলেও পুলিশ তার খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
মাদক সম্রাট আল আমিন ওরফে সুমনের বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার বাঘমারা গ্রামের মো.রনি গাজীর ছেলে। মাতা শাহিদা বেগম,বোন রাবেয়া বেগম ইয়াবা ও ফেন্সিডিল স¤্রাজ্ঞী।
আরেক ফেন্সিডিল স¤্রাজ্ঞী মিলি বেগম ওরফে মিলনী। তার বাড়ি সদর ইউনিয়নের শহরতলীর লালবাগ এলাকায়। এদের আবার মাসে মাসে ঠিকানা বদল করে।
আল-আমিনের দুইটি মোটর সাইকেল ও একটি নিজস্ব কালো রংয়ের প্রাইভেটকার রয়েছে। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারযোগে মৌলভীবাজার জেলারসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা পাচার করে থাকে। প্রতিদিন দুপুর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন স্পটে এসব মাদক ব্যবসা।
বিশেষ করে শহর ও শহরতলীর শাপলাবাগ,শাহীবাগ,লালবাগ,উত্তরসুর,নতুনবাজার লেবার কলোনী,আরামবাগ মুচিপট্রি,পশ্চিম ভাড়াউড়া,শাহজীবাজার,দ্বারিকাপাল মহিলা কলেজের সামনে,ভিক্টোরিয়া স্কুলের পেছনে,কালিঘাট ব্রীজ, জালালাবাদ গ্যাস অফিসের সামনে,টিকরিয়া চকগাও ,পূর্বাশা এলাকা,বিরাইম পুর,ভাড়াউড়া চা বাগান সংলগ্ন বার্ডস কলেজের পেছনে, জেডি রোড, শহরতলীর ৫নং পুল এলাকা ,ইউসুবপুর ও সিন্দুরখান এলাকাসহ বেশ কয়েকটি গেষ্ট হাউসে চলে এসব ব্যবসা।
অভিযোগ রয়েছে,মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেকটি সেক্টরের সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ম্যানেজ করে চলছে এসব মাদক ব্যবসা।
প্রাপ্ত মামলার কপি সূত্রে জানা যায়,আল-আমিন ওরফে সুমনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
রাজনগর থানার জিআর মামলা নং-৭৭/০৭,তারিখ-১.০৭.২০০৭ই। মৌলভীবাজার থানার মামলা নং-জিআর ১৫০/০৭, ০৮.৫.২০০৭ইং,। শ্রীমঙ্গল থানার মামলা নং-জিআর ১৮৪/১৫,তারিখ২৭.০৮.২০১৫ইং। শ্রীমঙ্গল থানার মামলা নং-১৩৯/১৬ইং। শ্রীমঙ্গল থানার জিআর মামলা নং-৫৩/১৫,তারিখ১২.০৩.২০১৫ইং। কমলগঞ্জ থানার জিআর মামলা নং-৩০/১৭ইং,তারিখ-২০.০২.২০১৭ইং। শ্রীমঙ্গল থানার জিআর মামলা নং-৫১/১৭ইংতারিখ-১৮.০২.২০১৭ইং। মৌলভীবাজার মডেল থানার মামলা নং-১৯১/১৫,তারিখ-০৭.৮.২০১৫ইং।
কুলাউড়া থানার জিআর মামলা নং-৪৫/০৭,তারিখ-২২.০৩.২০০৭ইং। শ্রীমঙ্গল থানার জিআর মামলা নং-১২/১৪ইং তারিখ-২১.০১.২০১৪ইং। মৌলভীবাজার মডেল থানার জিআর মামলা নং-১২/১৪,তারিখ-১৬.০১.২০০৭ইং।
মৌলভীবাজার মডেল থানার জিআর মামলা নং-৫৫/০৭ইং,তারিখ-১৫.০২.২০০৭ইং।মৌলভীবাজার মডেল থানার মামলা নং-১৭১/১৫,তারিখ-১৫.০৭.২০১৫ইং ও রাজনগর থানার জিআর মামলা নং-১৩/১০। বেশ কয়েকটি মামলার কপি সংগ্রহ করেছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইয়াবা ব্যবসায়ী আল-আমিনে ওরফে সুমনের নামে বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন থানায় রয়েছে একাধিক মাদকের মামলা। এসব মামলার বেশীর মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও আল-আমিন গ্রেফতার হচ্ছে না পুলিশের হাতে।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সঙ্গে আল-আমিন ওরফে গভীর সম্পর্ক থাকায় তাকে আটক করা তো দুরের কথা তার মাদকের চালানসহ তার বাহিনীর কোন সদস্য আটক হলেও মামলা দেয়া হয় না আল-আমিনের বিরুদ্ধে।
একটি নির্ভযোগ্য সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, আল-আমিনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন থানায় রয়েছে মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলায় তার সাজা হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরেও তাকে আটক না করায় খোদ পুলিশের মধ্যেই রয়েছে চাপা ক্ষোভ।
এবিষয়ে ইয়াবা সম্রাট আল-আমিন ওরফে সুমন মুঠোফোনে বলেন, ‘আগে একসময় মাদক ব্যবসা করতাম করি না। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ভাই মাঝে মধ্যে একটু একটু করি। তিনি (আমার)আপনার সাথে দেখা করবো বলে ফোন লাইন কেটে দেয়।’
শ্রীমঙ্গল শাপলাবাগ এলাকা তথা বিভিন্ন আশ-পাশের সচেতনমহল নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক একাধিক ব্যক্তিরা জানান,‘ইয়াবা গডফাদার আল-আমিনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। তার গ্রুপের মধ্যে রয়েছেন শাপলাবাগের রোজিনা বেগম,খাসগাঁও গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে জহির মিয়া, সেলিমের বাসার ভাড়াটিয়া আনোয়ার বাবুর্চী,আছাদ মিয়া বাসার ভাড়াটিয়া নেহার বেগম, খালেদ বাবুচির ছেলে ইয়াবা মামলার পলাতক আসামী আল-আমিন (২),শাপলাবাগের স্বপন মিয়া ও তার স্ত্রী মনি বেগম, সিদ্দিক মিয়ার ছেলে আজাদ মিয়া, শাপলাবাগ রেললাইনের পাশে ফল ব্যবসায়ী দেলোয়ার পাশের বাড়ীর মনোয়ার ও শিপন।
রেল স্টেশনের পুকুরপার এলাকার জমসেদ মিয়ার ছেলে ডাকাতি ও ইয়াবার মামলার পলাতক আসামী রুবেল মিয়া। হান্নান মিয়ার ভাড়াটিয়া রিপন ও ফেন্সিডিল স¤্রাজ্ঞী মিলি বেগম। এদের মধ্যে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ইয়াবা ও চুরি-ডাকাতির মামলা রয়েছে।
তারা আরও বলেন,এরা অভিনব কায়দায় মাদক পাচার করে। যেমন টিফিনে করে কেউ স্কুল ব্যাগে করে আবার কেউ লাউয়ের ভেতরে করে ইয়াবা ও গাঁজা,ফেন্সিডিল পাচার করে থাকে। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ একজন তিনি আল-আমিন মুঠোফোনের মাধ্যমে।’
অপরদিকে, ২৭ ফেব্রুয়ারী শ্রীমঙ্গল উপজেলার শহরতলীর জানাউড়া এলাকায় মাদকের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে জিটিভির মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হৃদয় দেবনাথ ইয়াবা গডফাদার আল-আমিনের সহযোগি রাজন মিয়া হাতের হামলার শিকার হন। পরে খবর পেয়ে শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এম ইদ্রিস আলী পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল থানার ওসি কে এম নজরুল ইসলাম বলেন,‘ইতোমধ্যে শ্রীমঙ্গল থানার ফেসবুক আইডিতে মাদক মুক্ত করতে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। মাদকের সাথে যারা জড়িত সে যেই হোক আমরা কাউকে ছাড় দিব না। মাদক মুক্ত গড়ার প্রত্যয় আমি আশার পর পরই গ্রহণ করেছি। প্রতিদিন মামলা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ী বা সেবনকারী আটক করা হলে তা কখনো ছাড়া হয়নিই। মাদক মুক্ত শ্রীমঙ্গল গড়তে চাই সকলের সহযোগিতা নিয়ে।’
মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ্জালাল বলেন,‘মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পুলিশের কোন সদস্যের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা।’
মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের সাংসদ ও সাবেক চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ ড.আব্দুস শহীদ এমপি শ্রীমঙ্গলে মাদকের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আপনারা (সাংবাদিক) মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মাদকের ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। মাদকের ছোবল থেকে উঠতি বয়সের যুবককে রক্ষা করতে মিডিয়া কর্মীর প্রতি আহবান জানান ওই সংসদ সদস্য।’



মন্তব্য করুন