নাব্য হ্রাসে অস্তিত্ব সংকটে মৌলভীবাজারের নদী ও গাঙ
ইমাদ উদ দীন॥ মানচিত্রে নদী ও গাঙ। কিন্তু বাস্তব দৃশ্যে তার মিল নেই। খর¯্রােতা ঐতিহ্যবাহী এ নদী ও গাঙগুলো এখন মৃত। নেই সেই জৌলস। নাব্যতা হ্রাসে এখন নিজেদের পরিচিতি পড়েছে সংকটে। তাই সোতস্বী এই নদী ও গাঙ নিয়ে শৈশবের স্মৃতির সাথে বিস্তর ফারাক হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এখন ধারণ ক্ষমতা না থাকাতে বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমি। স্থানীয় নদী ও গাঙ গুলোর এমন বেহাল দশায় বিরুপ প্রভাব পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছ,জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদ। নদী ও গাঙ্গগুলোর এমন মুমূর্ষ অবস্থা হলেও দেখার কেউ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন এমন দূর্দশা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই দৈন্য দশায় নদী ও গাঙগুলো নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে তাও বিলিন হয়ে যাবে। তারা জানালেন প্রতিবছরই পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদী ও গাঙ। আর এই সুযোগে চলছে দখল উৎসব। যে যার মত প্রভাব খাটিয়ে চালাচ্ছেন দখল দ্বারিত্ব। একারনে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। নদী ও গাঙ মানুষের দখলে গিয়ে রুপ বদলাচ্ছে। ভরাট হওয়া অংশে গড়ে ওঠছে ঘরবাড়ি কিংবা ক্ষেতের ভূমি। এখন এমন বেহাল দশায় মৌলভীবাজারের ৫টি নদী ও সবক’টি গাঙ। এ কারনে বর্ষা মৌসুমে যেমন বন্যা হয়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। জেলার অন্যতম নদী মনু, ধলাই, ফানাই, সোনাই ও জুড়ীর এখন বেহালদশা। অন্যদিকে শাখা নদী বরাক, বিলাস, লাংলী, গোপলা ও আন ফানাই নদীর অস্তিত্বই বোঝার উপায় থাকে না শুষ্ক মৌসুমে। নাব্যতা হ্রাসের কারনে বর্ষা মৌসুমে পানির ধারন ক্ষমতা না থাকায় নদী ও গাঙ গুলোর দু’তীর ভেঙ্গে প্লাবিত হয় আশপাশের গ্রাম। পানিতে তলিয়ে গিয়ে ক্ষতিহয় ঘরবাড়ি ও চাষাবাদের। ওল্টো চিত্র শুষ্ক মৌসুমে নদী ও গাঙ গুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েন তীরবর্তী এলাকার চাষীরা। নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানান মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মনু নদীর বিভিন্ন স্থানে শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে ওঠে।
কুলাউড়ায় ফানাই, কমলগঞ্জে ধলাই ও জুড়ী উপজেলা জুড়ী ও সোনাই নদীর একই অবস্থা। জানা গেল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের পাশে কুশিয়ারা নদীর একটি শাখা বরাক নাম ধারণ করে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শীতকালে বরাক একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। গরু, ছাগল, মেষ চড়ানো হয় নদীর বুকে। শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট দিয়ে প্রবাহিত লাংলী নদী হেতিমগঞ্জ নামক স্থানে বিলাস নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে আসা এ নদীর রূপরেখা খালে পরিণত হয়েছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গোপলা নদী তার ঐতিহ্য হারিয়েছে শুধুমাত্র পলির কারনে ভরাট হয়ে। কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ের বাসিন্দারা জানান আন ফানান একসময় খর¯্রােতা থাকলেও এখন নানা কারনে ভরাট হয়ে যাওয়াতে নেই সেই জৌলস। সিন্দুরখান এলাকার বাসিন্দারা জানান, লাংলী নদীর বিভিন্ন অংশ বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাছে লাংলী নদী নয় এখন তা কালেঙ্গিছড়া হিসেবে পরিচিত। শীতকালে নদীর বুকে চাষাবাদ হয় শাকসবজি, চড়ানো হয় গরু ও ছাগল। অন্যদিকে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদীর অংশের তলদেশ পলি জমে ভরাট হওয়ায় দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি সমান্তরাল হয়ে গেছে। এতে হাওর দু’টি পানি নিষ্কাশন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর একারনে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হাওর দুটির নিত্যসঙ্গী। তাই আমন ও বোরো চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন স্থানীয় কৃষকরা। অন্যদিকে পলি জমে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে হাওরের সংযোগ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। এই নদী গুলোর সাথে গাঙ্গ, ছড়া ও খাল গুলোর সংযোগ নাব্য হ্রাসের কারনে বিলুপ্ত হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন। স্থানীয় চাষীরা জানান দীর্ঘদিন থেকে ভরাট হওয়া নদী ও গাঙ পুনঃখনন না হওয়াতে বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে আগের মত তারা চাষাবাদ করতে পারছেন না। শীতকালে আগে কৃষকরা সেচ সুবিধা পেয়েছিল। তখন কৃষিক্ষেত্রে এসেছিল অভাবনীয় সাফল্য। এই নদী গুলো দিয়ে একসময় বড় লঞ্চ,নৌকা চলাচল করত। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল নৌপথকে ঘিরে।
অথচ এখন শুষ্ক মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে এই নদীগুলো পার হতে হয়। কালের প্রবাহে এই নদী গুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে খালে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ. স. ম ছালেহ সুহেল বলেন নদী ও গাঙ গুলো ভরাট হয়ে অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। এতে দেশীয় প্রজাতির মাছসহ জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভরাট হওয়া এজেলার স্থানীয় নদী ও গাঙগুলো পরিকল্পিত ভাবে দ্রুত খননের প্রয়োজন। নদী ও গাঙ গুলো পুনখনন হলে তখন অবৈধ দখলও থাকবেনা। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান বন্যা ও খরা থেকে জলজপ্রাণী,উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় ভরাট হয়ে যাওয়া নদী গুলো খননের প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় স্থানীয় নদী গুলো খনন ও স্থায়ী সুরক্ষায় একটি প্রস্থাবনা ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এবিষয়ে সরকারের পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি বলেন হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ নিষ্কাশন ও উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন সরকার। এই প্রকল্পে অতি জরুরী কাজ গুলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হবে। তিনি জানা জেলার সোনাই নদীর ৮ কিলোমিটার খনন কাজ শিগগিরই শুরু হবে এতে ১৮ কোটি ৭৯ লাখ প্রাকল্লিত ব্যয় ধরা হয়েছে। আর জুড়ী নদীর ১০ কিলোমিটার খননে প্রাকল্লিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এই কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ। ৮ মার্চ টেন্ডার ওপেনিং হবে। কাজও শুরু হবে খুবই দ্রুত।



মন্তব্য করুন