বণ্যপ্রাণী দিবসে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়ায় ৮টি বণ্যপ্রাণী অবমুক্ত

March 3, 2018,

বিকুল চক্রবর্তী॥ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসে বন্যরা ফিরে পেলো বনের স্বাদ। বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণী অবমুক্তের মধ্য দিয়ে শ্রীমঙ্গলে পালিত হয়েছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। আর এ দিবসকে সামনে রেখে জীবযন্তু ও পশুপাখিসহ প্রায় ৮টি প্রাণী অবমুক্ত করা হয় বলে জানান, বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব।
৩ মার্চ শনিবার বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব এর সভাপত্বিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণী অবমুক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রাণীগুলো অবমুক্ত করেন বিজিবি শ্রীমঙ্গল সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মো. জাহিদ হোসেন ।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মিহির কুমার দো, শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি চৌধুরী ভাস্কর হোম, প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি শামীম আক্তার হোসেন, সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান, বৃক্ষ সংরক্ষনে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী, প্রকৌশলী গৌতম কুমার দেব প্রমুখ।
অবমুক্ত করা প্রাণীগুলোর মধ্যে ছিল একটি গন্ধগকুল, একটি বন বিড়াল, একটি বাদামী বানর, একটি অজগর সাপ, দু’টি সড়ালি পাখি ও দু’টি খালিম পাখি।
পরে অতিথিরা বনের ভিতরে একটি নাগলিঙ্গম গাছের চারা রোপন করেন। দেশের বন্য প্রাণী বিচরনকারী এলাকার মধ্যে একটি হচ্ছে মৌলভীবাজার। তাই এ জেলার বন্যপ্রাণীকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ফিরিয়ে দেয়ার আহবান নিয়ে মৌলভীবাজারে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংগঠনও বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে দিবসটি পালস করছে।
এক সময় মৌলভীবাজার জেলা ছিল ঘন বনাঞ্চলে আবৃত্ত। যে কারনে এ জেলায় আবাসস্থল ছিল প্রচুর বন্যপ্রাণীর। কিন্ত সময়ের আবর্তে বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় এবং বনাঞ্চলে আবৃত্ত হাজার হাজার একর সরকারী খাস ভুমি দখল করে বাড়িঘর ও আনারস, লেবু, পান বাগানসহ বিভিন্ন ভাবে জঙ্গল উজার করে প্রকৃতি পরিবর্তন করার ফলে এ জেলার বন্যপ্রাণীরা আজ বিলুপ্তীর পথে। আর বিলুপ্তির অবশিষ্টাংশ লাউয়াছড়া বন কিছু বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয় স্থল হলেও লাউয়াছড়ার ভিতরদিয়ে বয়ে চলা রেল লাইন, বাস লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন, বন উজার করে লেবুবাগান, বাড়িঘর নির্মানসহ নানা কারনে এখানেও বন্যপ্রাণী গুলো বসবাস করছে ঝুঁকি নিয়ে। এতে মারা পড়ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।
এ ছাড়াও এ জেলায় বন্যপ্রাণীর বিচরন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ছিল সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জের পশ্চিম ভানুগাছ বন, আদমপুর বন বিট, কুরমা বন বিট, কালাছড়া বন বিট, কুলাউড়ার মনছড়া বনবিট, বড়লেখার মাধবকুন্ড পাতারিয়া বনাঞ্চল, মৌলভীবাজার সদরের বর্ষিজোড়া বন, জুড়ির সাগরনাল ও শ্রীমঙ্গল সাঁতগাও বন বিটসহ আরও কয়েকটি বন। কালের আর্বতে এই বনের কোন কোনটা প্রায় নি:শেষ। আর কোনটা নামে মাত্র টিকে আছে। অতচ এই বন গুলোতে ২৫/৩০ বছর আগেও ছিলো প্রচুর পরিমানে গাছপালা ও বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। জনশ্রুত রয়েছে শ্রীমঙ্গল সাঁতগাও বন বিটে একটি বাঘের বিচরন ছিলো। প্রায়ই ওই বাঘ গরু ছাগল খেয়ে ফেলতো। সাঁতগাও ইছামতি চা বাগানে শত শত বর্ষ পূর্বে প্রতিষ্টিত শ্রী শ্রী মঙ্গল চন্ডীর থলি এলাকায় বাঘ আসতো বলেও লোকমুখে শোনাযায়। অন্যদিকে বন্যপ্রাণী প্রেমী সিতেশ রঞ্জন দেব এর উপর ভাল্লুকে আক্রমনের খরবতো প্রায় সকলে জানাই আছে। আজই সবই গল্প। তবে এখনও মাঝে মধ্যে কমলগঞ্জের আদমপুর, কুরমা বিটে বেশ কিছু বন্যপ্রাণীর বিচরনের খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে বণ্যপ্রাণী শিকারীরা মায়া হরিণ শিকার করে নিয়ে যাওয়ার ও শিকার করে পালানোর সময় মৃত প্রাণীটি উদ্বারের ঘটনা প্রায়ই ঘঠে। আর লাউয়াছড়া বনের বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার খরবতো প্রতিনিয়তোই গণমাধ্যমে উঠে আসে।
লাউয়াছড়া বন। যা শত বছরের একটি জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ বন। যার বুক ছিড়ে বয়ে গেছে রেল লাইন। এই লাইন দিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ টা ট্রেন অতিক্রম করে। একই সাথে এর ভিতর দিয়ে পাকা সড়কে গাড়ি চাপায় এবং বিদ্যুৎ লাইনে লেগে প্রাণ হারায় বাঘ, হরিণ, সাপ, বানর, উল্লুকসহ বিভিন্ন পশু পাখি। বনের ভিতরে রয়েছে পর্যাপ্ত জলাধারের অভাবও।
অন্যদিকে গ্রামীণ ঝোঁপ ঝাড় কেটে ফেলায় ওই সব এলাকায় বসবাসকারী বন্য প্রাণী গ্রামের ভিতরে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে গিয়ে মানুষের হাতে কখনও মারা পড়ে কখনও বন্দি হয়। বিভিন্ন সময় লাউয়াছড়া বনেরও কিছু প্রাণী লোকালয়ে ছুঠে গিয়ে ধরা পড়ে মানুষের হাতে। এই প্রাণী গুলোকে উদ্ধার করে আবার বনে অবমুক্ত করা হয়। আর এ জাতীয় একটি মহৎ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন শ্রীমঙ্গলের পশুপাখি প্রেমী সিতেশ রঞ্জন দেব। তিনি বিপন্ন বন্য প্রাণীর জন্য গড়ে তুলেছেন একটি বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। যার মাধ্যমে তিনি মানুষের হাতে ধরা পড়া প্রাণীগুলোকে উদ্বার করে সেবা যতেœর পর আবার বনে অবমুক্ত করেন।
এ ব্যাপারে সিতেশ রঞ্জন দেব জানান, চোখের সামনে সব পাল্টে গেছে। এ অঞ্চলের বন্যপ্রাণীগুলোতো তার কাছে এখন স্বপ্নের মতো। তিনি জানান, লাউয়াছড়া ও আসপাশের বনে চিতাবাঘ, সাম্ভার, ভাল্লুক, চিত্রা হরিণ, সজারু, বনরুইসহ অসংখ্য প্রাণী বিচরণ করতে দেখেছেন। যার বিলু্িপ্তর মুল কারন এ এলাকার বনাঞ্চল কমে যাওয়া। তিনি জানান, প্রথমে খাসভুমির বনাঞ্চল উজার করেছে , এরপর চা বাগান এলাকার পরে রিজার্ভ ফরেষ্টে। তিনি বলেন আজকের লাউয়াছড়া বন এভাবে ছিলনা। লাউয়াছড়া বনের ভিতর দিয়ে দিনের বেলা লাইট জ্বালিয়ে যানবাহন অতিক্রম করতে হতো। সেই বড় বড় গাছের একটিও আজ আরনেই। রাস্তার দু পাশে কয়েকটি গাছ ও আর লাতা পাতার মধ্যেই এখন লাউয়াছড়া। অবশ্য এ জন্য তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদাসিনতা, সরকারী কর্মকর্তাদের অনিহাকে দায়ী করেন। তবে সম্প্রতি সময়ে বনবিভাগের প্রানান্তকর চেষ্টাকে তিনি সাধুবাদ দেন। তাদের এই চেষ্টা অভ্যাহত রাখতে হবে জানান। তবে এখনও কিছু কিছু কর্মকর্তা আছেন যাদের সর্ম্পক রয়েছে বন উজারকারীদের সাথে তাদের প্রতি সংশ্লিষ্ট মহলের নজর রাখার প্রতিও জোড় দেন তিনি । উদাহরন দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বন বিভাগের দখলীয় ভুমি যেখানে গাছপালা ও বন অফিস বিদ্যমান সে বন কিভাবে চা বাগান করার অযুহাতে লিজ হয়ে যাবে ? কয়েক বছর আগে কুলাউড়া মনছড়া বন লিজ নেয়ার জন্য পাশবর্তী কালিটি চা বাগানের মালিক সকল প্রকৃয়া সম্পন করেন। গণ্যমাধ্যমের এই সংবাদ প্রচারের কারনে ও বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার নড়াচড়ায় বর্তমানে তা রয়েছে ঝুলন্তবস্থা। যে কোন সময় মৃত্যু ঘটতে পারে এই বনের। মনছড়া বনের গাছপালা সব কেটে ফেললে ওই বনের জীবযন্তুু আবাসস্থল হবে কোথায়।
এদিকে বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জানালেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো: তোফায়েল ইসলাম। তিনি জানান, যে সকল ব্যাক্তি এই বন বিনষ্টে লিপ্ত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তারা আইনগত ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। তিনি জানান, যারাই বনের জায়গা দখল করে রেখেছেন তা উদ্বার করে পুনরায় বনায়ন করা হবে। বিশেষ করে লাউয়াছড়া বনকে পরিপূর্ণ অভায়ারণ্য হিসেবে রুপদিতে সবধরনের ব্যবস্থা নেয়ারও প্রতিশ্রুতিদেন তিনি। তিনি বলেন লাউয়াছড়া, শুধু, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্য না এটা সারা বিশ্বের একটি ঐতিহ্যবাহী রেইন ফরেষ্ট। তাই এটিকে আমাদের সবাই মিলে ধরে রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মিহির কান্তি দো জানান, এই বনের জীব বৈচিত্র ধরে রাখতে তারা প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তারা লাউয়াছড়ার সীমানা নির্ধারন করে ফিলার স্থাপন। বনের ভিতরে স্থাপিত অবৈধ লেবুবাগান উচ্ছেদ করেছেন। বেশ কিছু গাছ চুরকে ধরে মামলাও দিয়েছেন।
আর সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান জানান, লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণী ও পশু পাখির সংখ্যা বেড়েছে। গাছপালা উজার কম হচ্ছে বলেই তা সম্ভব হচ্ছে। তবে বনের পরিধি বাড়ানো দরখার। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের উর্ধতন মহলের হস্তক্ষেপে বনের ভিতরে বসবাসকারীদের স্থানান্তরিত করতে হবে।
আর শনিবার লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণী অবমুক্ত করতে এসে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজিবি শ্রীমঙ্গল সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মো: জাহিদ হোসেন বলেন, বন্যপ্রাণী ও গাছপালা রক্ষা করা প্রত্যেক সু নাগরিকের কর্তব্য। সরকারের দ্বায়িত্বশীল বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় জন সাধারণকে এই বনের গুরুত্ব বিবেচনা করে তা রক্ষায় ভুমিকা রাখতে হবে। কারন এই বন সারা বিশ্বে পরিচিত একটি বন। আর আমাদের জাতীয় সম্পদ।
পশু পাখি জীবযন্তুর জন্য রক্ষা করতে হবে গাছ পালা আর গাছপালার জন্য রক্ষা করতে হবে বন। তাই মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, মনছড়া, কালাছড়া, সাঁতগাও, বর্ষিজোড়া, মাধবকুন্ড ও কুর্মাসহ প্রত্যেকটি বন রক্ষা এবং বাড়ি ঘরের পাশের ঝোপঝাড় ও হাজার হাজার একর খাস ভুমির বনাঞ্চল রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে উদ্যোগ নেয়ার দাবী এ জেলার প্রকৃতি প্রেমীদের।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com