বোরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা : পাকা ধান মাঠে বজ্রপাতের ভয় কৃষকের

May 10, 2018,

ইমাদ উদ দীন॥ পাকা বোরো ধান মাঠে দোল খাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাশিত সে ধান ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক। গেল প্রায় ১০-১২ দিন থেকে এসংকট ঘনিভূত হচ্ছে। কারন সকাল থেকেই আকাশ থাকছে মেঘাচ্ছন্ন। আর এরই সাথে থাকছে ঝড়ো হাওয়া,বিজলী চমকানো,ভারী বৃষ্টি ও বজ্রাপাত। গেল সোমবার এজেলায় বজ্রপাতে ২ জন নিহত ও ৩জন আহত হওয়াসহ দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়ে চলাতে এখন বজ্রপাত আতংক বিরাজ করছে। আর একারনে অনুকূল আবহাওয়া না হলে কেউই ঘর হতে বের হচ্ছেন না। আকাশের অবস্থা দেখে চাষীরাও মাঠে যাচ্ছেন। বোরো চাষী কৃষকদের সাথে আলাপে তারা জানালেন মাঠে পাকা ধান সংগ্রহে তারা ভয় নিয়ে ক্ষেতের জমিতে নামছেন। কারন এবছর বজ্রপাত নিয়ে তারা আতংকে আছেন। তাই আকাশে বিজলী চমকালে কিংবা মেঘাচ্ছন্ন হলেই তারা দ্রুত ঘরে ফিরছেন। এতে পাকা ধান কাটা হচ্ছে কম।
এদিকে সময় যত যাচ্ছে ভারী বৃষ্টিপাত বেড়ে চলায় পাকা বোরো ধানও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। তারা জানালেন এবছর পানিতে জোঁক আর আকাশ থেকে নামছে বজ্রপাত। এই দুই ভয় এজেলায় ধান কাটা শ্রমিকের সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে। ৫শ-৬শ টাকা মজুরী দিয়েও মিলছেনা ধান কাটা শ্রমিক। কৃষকরা জানালেন আরো সপ্তাহ দিন আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাবে।এতে জেলার মোট বোরো আবাদের ১০-১৫ ভাগ ফসল ঘরে উঠানো যাবেনা।
সরজমিনে জেলার কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর এলাকায় গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। জেলার হাকালুকি ও হাইল হাওরের বিল এলাকায় আবাদকৃত বোরো ধান কাটা প্রায় ৯৬ ভাগ শেষ হয়েছে। তবে কাউয়া দিঘি হাওরে সেচ পাম্প সুবিদা থাকায় ওই হাওরে প্রায় ৩৭ ভাগ ধান এখনো কাটা হয়নি। কাটার অপেক্ষায় থাকা বেশির ভাগ ধানই ব্রি-ধান-২৯ ও বিআর-১৪ জাতের ধান। আর জেলার হাওর ও নদী তীরবর্তী উচুঁ এলাকায় আবাদকৃত বোরো ধান কাটা প্রায় ৭৮ ভাগ শেষ হয়েছে। জানা যায় এবছর স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী জেলার তিনটি হাওরের বিল এলাকায় আগাম জাতের ধান ব্রি-ধান-২৮ আবাদ করেন চাষীরা। আর বিআর-১৪ ও ব্রি-ধান-২৯ আবাদ হয় হাওর ও নদী তীরবর্তী অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে। বিআর-১৪ ও ব্রি-ধান-২৯ ধানের ফলন ভালো হলেও ফলন কম হয়েছে ব্রি-ধান-২৮ এর। ব্লাস্ট ও নেক ব্লাস্ট এর কারনে অধিকাংশ ব্রি-ধান-২৮ এ ছিটা হওয়াতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন কৃষক। এর অন্যতম কারন হিসেবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন এবছর বোরো আবাদের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ব্লাস্ট রোগের বিস্তার ঘটেছে বেশি। যে হেতু মৌসুমের প্রথম দিকে ২৮ ধানের চারা লাগানো হয়েছে সে কারনে ওই ধানই বেশি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তবে ব্রি-ধান-২৯ ও বিআর-১৪ ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত কম হওয়ায় ফলন ভালো হলেও এখন বজ্রপাতের ভয়ে তা পুরোপুরি ভাবে ঘরে তোলতে পারছেননা কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায় এবছর জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৫৪.১২ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলে ১৯ হাজার ৩ শত ৬৬ হেক্টর। বাকিটুকু চাষ হয়েছে নদী ও হাওরের তীরবর্তী এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন (চাল) হাইব্রিড ৪ টন। আর উচ্চ ফলনশীল ৩ টন। তাদের তথ্য মতে এবছর এপর্যন্ত জেলার হাওরে ৯৯ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে। আর হাওর ছাড়া প্রায় ৬৭ ভাগ ধান কাটা শেষ। পুরো জেলায় এপর্যন্ত প্রায় ৭৮ ভাগ বোরো ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বিকেলে হাইল হাওরের তীরবর্তী কাইঞ্জর বন্দ ও বিন্নার বন্দ এলাকায় গেলে কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সাথে। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ায় তারা দ্রুত বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
মোকাম বাজার এলাকার জরিফ মিয়া (৪৮),গুমরা গ্রামের হামদু মিয়া (৬৮),শরিফ মিয়া (৪৫),কালাপুরের মছকন মিয়া (৪২), রফিকুল ইসলাম (২৪),সাইদুর রহমান ইমন (৩০) জানালেন এবছর ব্রি-ধান-২৮ জাতের ধান ছাড়া অনান্য জাতের ধান ভালো হয়েছে। বিঘা প্রতি মিলছে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান। কিন্তু এখন আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় আর বজ্রপাতের ভয়ে মাঠে থাকা পাকা ধান ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছেনা। শ্রমিক কিংবা মালিক কেউই এখন বজ্রপাতের ভয়ে ক্ষেতের মাঠে যেতে চাননা। আবহাওয়া ভালো দেখে ক্ষেতের মাঠে গেলেও সেখানেও থাকতে হয় শঙ্কায়। তারা নিজেদের ক্ষেতের জমি দেখিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে ভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে ২-৩ দিনের মধ্যেই পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যাবে।
কৃষকরা জানান গেল ২-৩ বছরের মত তারা আগে এভাবে বজ্রপাত হতে দেখেননি। তারা বলেন এভাবে বজ্রপাত হলে আগামীতে বোরো চাষ অনেকটায় ব্যাহত হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: শাহজাহান বলেন এবছর জেলা জুড়ে বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। শুধু ব্রি-ধান-২৮ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এজাতের ধানের ফলন একটু কম হয়েছে। হাওর এলাকায় বোরো ধান কাটা শেষ হলেও নদী ও হাওর তীরবর্তী এলাকার অপেক্ষাকৃত উচুঁ অংশে এখনো বোরো ধান কাটা শেষ হয়নি।
সম্প্রতি বজ্রপাত শুরু হওয়ায় ভয়ে মাঠে যাচ্ছেননা কৃষক। এছাড়া বজ্রপাতের ভয় থাকায় আউশ ধানের চারা রোপনেও মাঠে কাজ করতে সাহস পাচ্ছেননা কৃষক। মাঠ পরিদর্শনে গেলে কৃষকরা তাদের ভয়ের কথা আমাদের বলছেন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com